
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুত গতিতে রূপ নেয় একটি গণবিস্ফোরণে, যা শেষ পর্যন্ত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ডেকে আনে। এই প্রতিবেদনে আমরা সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের সূচনা, বিকাশ, চূড়ান্ত ফলাফল এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিশদভাবে আলোচনা করব।
আন্দোলনের সূচনা ও পটভূমি:
২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়, যেখানে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় । এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা "বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন" নামে একটি আন্দোলনের ডাক দেয় এবং তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
শুরুতে আন্দোলনের মূল দাবি ছিল সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৫৬% কোটা (যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%, নারী কোটা ১০%, জেলাভিত্তিক কোটা ১০%, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোটা ৫% এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা ১%) বাতিল করা । শিক্ষার্থীদের যুক্তি ছিল, এই কোটা ব্যবস্থা মেধার স্বীকৃতিকে ক্ষুণ্ন করছে এবং সরকারি চাকরিতে অদক্ষ লোক নিয়োগের পথ প্রশস্ত করছে।
আন্দোলনের ক্রমবিকাশ: শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে গণঅভ্যুত্থানে জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
২ জুলাইঃ শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় এক ঘণ্টা অবরোধ করে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে ।
৪ জুলাইঃ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করতে অস্বীকৃতি জানায়, যা আন্দোলনকারীদের আরও উৎসাহিত করে।
৬ জুলাইঃ বাংলা ব্লকেড' নামে একটি ব্যাপক অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়, যেখানে রাজধানীর শাহবাগ, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবসহ প্রধান প্রধান সড়কগুলো কয়েক ঘণ্টার জন্য অবরোধ করা হয় ।
১০ জুলাইঃ আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের জন্য কোটার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকে ।
১৪ জুলাইঃ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, "মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?"। এই মন্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে "তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার" স্লোগান ওঠে ।
১৫ জুলাইঃ পরিস্থিতি সহিংস রূপ নেয় যখন ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যা পুরো দেশে আন্দোলনকে আরও উসকে দেয় ।
সরকারের দমননীতি ও আন্দোলনের ব্যাপকতাঃ
হাসিনা সরকার প্রথমে আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিলেও পরে কঠোর দমননীতির পথ বেছে নেয়।
সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দেওয়া হয়
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শতাধিক মানুষ নিহত হন
সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়
তবে সরকারের এই দমননীতি আন্দোলনকে দমাতে ব্যর্থ হয়। বরং এটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে যোগ দেয়। আন্দোলন দ্রুত "সরকার পতনের এক দফা" দাবিতে রূপ নেয় ।
হাসিনা সরকারের পতন ও ভারত গমনঃ
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে প্রবল জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যান । তার পতনের দিন ঢাকাসহ সারাদেশে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং আনন্দ প্রকাশ করে ।
হাসিনার পতনের মূল কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা তার সরকারের একগুঁয়েমি, অহংকার ও জনবিচ্ছিন্ন নীতিকে চিহ্নিত করেছেন । দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে শত্রু বানিয়েছিলেন এবং ভূরাজনীতিতে প্রায় একা হয়ে পড়েছিলেন । কোটা আন্দোলনকে সামলাতে তার সরকারের ব্যর্থতা ছিল পতনের চূড়ান্ত কারণ।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ তিন দিন সরকারবিহীন অবস্থায় থাকে। ৮ আগস্ট দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে এবং ২০২৬ সালের এপ্রিলে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেয় ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হাসিনার পতনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখায়:
যুক্তরাষ্ট্রঃ বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকার ঘোষণা দেয় এবং সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানায়।
ভারতঃ শেখ হাসিনাকে সাময়িক আশ্রয় দেয় এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে ।
যুক্তরাজ্যঃ শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও প্রাণহানি রোধে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানায়।
চীনঃ বাংলাদেশে দ্রুত সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আশা প্রকাশ করে ।
জুলাই আন্দোলনের ফলাফল ও তাৎপর্যঃ
জুলাই আন্দোলন ও হাসিনা সরকারের পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গভীর প্রভাব ফেলে:
১. রাজনৈতিক পরিবর্তনঃ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের অবসান ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে ।
২. মানবিক ক্ষয়ক্ষতিঃ আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আন্দোলনে ১,০০০-১,৫০০ মানুষ নিহত এবং ২৩,০০০-এর বেশি আহত হন ।
৩. আইনি সংস্কারঃ কোটা ব্যবস্থা সংস্কারসহ বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয় ।
৪. সামাজিক প্রভাবঃ আন্দোলন বাংলাদেশের সমাজে তরুণদের শক্তি ও সংগঠন ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে কাজ করে।
৫. আন্তর্জাতিক ইমেজঃ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনার নতুন পরিচয় বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি প্রমাণ করেছে যে কোনো স্বৈরাচারী শাসনই শেষ পর্যন্ত জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাজিত হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ গণঅভ্যুত্থানে, যা দীর্ঘদিনের একটি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। যদিও আন্দোলনের পথ রক্তাক্ত ছিল, তবুও এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনাকে নতুন করে জাগ্রত করেছে। এখন দেশবাসীর চোখ ২০২৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের দিকে, যা হবে হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথম জাতীয় ভোট ।
শিহাব