ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশী ঋণের প্রভাব ও করণীয়

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ২৯ মার্চ ২০২৪

বিদেশী ঋণের প্রভাব ও করণীয়

.

বাংলাদেশের অর্থনীতিতেঋণশব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দের একটি। সারাবছর শব্দটি দাপিয়ে বেড়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের সংস্কৃতির কারণে। অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের বিষয়টি একটি ফুটো পয়সাও ঋণ না নেওয়া সাধারণ মানুষের কাছে গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারা ধরেই নিয়েছে ভ্যাট-ট্যাক্স-সিন্ডিকেট অর্থ আত্মসাতের পাকচক্রে পড়ে যাওয়া তাদের সাদামাটা জীবন এভাবে কোনোমতে বইয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, চলমান স্বজনতোষী অর্থনীতি ব্যবস্থায় ধনী আরও ধনী হয়, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, ফেরত দেয় না; ঘুষ-দুর্নীতি করে, সরকার হুমকি-ধমকি দেয়; সাদা করার নামে অবৈধ পুঁজির কিছু অংশে শিল্পকারখানা করে, বাকিটা শেয়ার-বন্ডের ফটকাবাজারে বিনিয়োগ করে, না-হয় বিদেশে পাচার করে দেয়। এই পাকচক্র অনন্তকাল চলতেই থাকে, থাকবে। ঋণ নিয়ে শুরু করা এই আলোচনার ডালপালা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হওয়ার আগেই বলে রাখি, ঋণ প্রসঙ্গটি এখন নতুন করে সামনে এসেছে পুরো বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রমের খবরে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি জনগণকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ন্ডাবাচ্চা থেকে শুরু করে সব মানুষের সম্মিলিত বিদেশী ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সাল শেষে তিন অংকের সীমা ছাড়িয়ে ১০০ দশমিক বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১১ লাখ হাজার ৪০ কোটি টাকার সমান ( ডলার ১১০ টাকা হিসাবে) জনগণের পক্ষে এই ঋণের ৭৯ শতাংশই নিয়েছে সরকার এবং বাকি ২১ শতাংশ বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। জানা গেছে ডলারের সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক সুদের উচ্চহারের কারণে বিদেশী ঋণ নেওয়া বেসরকারি খাত এড়িয়ে চললেও সরকার নানা মাধ্যম থেকে দেদার ঋণ নিচ্ছে, যা আরও বছর দুয়েক ধরে চলবে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলার সংকট উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে, তার ওপর ইতোমধ্যেই বড় কিছু প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ শুরু হয়েছে এবং পাশাপাশি রপ্তানি রেমিটেন্সও প্রত্যাশিত বাড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডলার উপার্জনের সর্বোচ্চ উদ্যোগ না নিয়ে বেশি ঋণ নিতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। তাদের মতে, আর কোনো ঋণ না নিলেও এর কুপ্রভাব দুতিন বছর পর বড় বড় মেগা প্রকল্পের মূল অর্থ সুদ পরিশোধ একসাথে শুরু হলে পরে জনগণ টের পাবে।

সাধারণ মানুষের বোঝার স্বার্থে বলা প্রয়োজন, যে কোনো দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত হিসাবে নেওয়া মোট অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এই অর্থ তারা ঋণ বা অন্য কোনো কাজে খরচ করতে পারে না। আর রপ্তানি, রেমিটেন্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি, ঋণ সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষিত থাকে, সেটাই একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং এই দুই খাত মিলেই একটি দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার। ঋণের টাকা লুটপাট অব্যবস্থাপনায় বেকায়দায় পড়া কোনো ব্যাংক বন্ধ হওয়ার দশা হলে গ্রাহকদের অর্থচাহিবামাত্রফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে রাষ্ট্র তার কোষাগারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জমা রাখা টাকার সঙ্গে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে দেওয়া কর দিয়ে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে থাকা বৈদেশিক মুদ্রায় জ্বালানি-খাদ্য আমদানি ব্যয়, শিক্ষা, বিদেশে ভ্রমণ এবং বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয়। অর্থনীতির তত্ত্বমতে, একটি দেশের তিন মাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হয়, যা বাংলাদেশের এখন আছে কমবেশি ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো। কৃচ্ছ্র সাধন করে চললে ২০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে বাংলাদেশের তিন-চার মাস দিব্যি চলে যাবে। এখন ঋণের আসল সুদ এবং আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ মাঝে মধ্যেই হ্রাস পাচ্ছে, যা সরকার বিদেশে পণ্য রপ্তানি প্রবাসে থাকা বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং বিদেশী সংস্থা সরকারের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে পূরণের চেষ্টা করছে। অনেক অর্থনেতিক বিশ্লেষক মনে করেন, সরকারের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু ক্রমাগত বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কেননা, বাংলাদেশের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে এবং সরকার দেশের অভ্যন্তর থেকে আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে ঘাটতি নিরসনে বিদেশী রাষ্ট্র সংস্থার কঠিন শর্ত স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি নিচ্ছে। প্রবণতা যে কোনো রাষ্ট্র সরকারের জন্যই বিপজ্জনক। বাংলাদেশের জন্য বিদেশী ঋণের মূল সমস্যা হলো- বৈচিত্র্যহীন পণ্য রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি খুব কম, তার ওপর রেমিটেন্সের আয় অদক্ষ শ্রমনির্ভর এবং প্রতিবছর বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া।

কথা সবর্জনস্বীকৃত যে, বাংলাদেশের ন্ডারের মতো মোটা চামড়ার সংখ্যাস্বল্প ঋণখেলাপি ছাড়া যে কোনো ব্যক্তি বা রাষ্ট্র যখন ঋণ করে, তখন তাকে আরেকজনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন যিনি একাধারে লেখক, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সঙ্গীতজ্ঞ, উদ্ভাবক, কৌতুকবিদ, গণআন্দোলনকর্মী এবং কূটনীতিক, তার একটি উক্তি বেশ প্রণিধানযোগ্য। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন বজ্রনিরোধক দন্ড, বাইফোকাল লেন্স, ফ্রাংকলিন চুলা, অডোমিটার (দূরত্ব মাপার যন্ত্র), হারমোনিকা এবং ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের আবিষ্কার করে এখনো অমর হয়ে আছেন। তিনি এখন থেকে ২৭৫ বছর আগে মার্কিনীদের ধারকর্জ বা ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, “ঋণ নিয়ে জেগে ওঠার চেয়ে রাতের খাবার না খেয়ে ঘুমাতে যাওয়া অনেক ভালো। কারণ যখন কেউ ঋণ করে, তখন সে দাস হয়ে যায়।আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে এই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত। শিক্ষাও তাদের নিতে হয় ঋণ করে। অথচ বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের সময় দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান ধর্মানুসারীরা ঋণ নেওয়া এড়িয়ে চলত সুদের কারণে। আর সে সময়ই জার্মানি ইংল্যান্ডভিত্তিক ইহুদিরা সুদি ব্যাংক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে মার্কিনীদের নামমাত্র সুদ শর্তে দেদার ঋণ দিতে দিতে এখন এমনই হাল করেছে যে, ধনে-মানে-ক্ষমতায় বিশ্বে এক নম্বর এই দেশটির ৯০ শতাংশ তরুণই মনে করেন, তাদের সবকিছুর মালিক নিয়ন্ত্রক হলো জনসংখ্যার মাত্র শতাংশ প্রতিনিধিত্বকারী ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট নিয়ে খোঁজখবর করলে বিষয়টি সবার কাছে আরও খোলাসা হবে। সে যাই হোক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশী ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৫ বছর আগে ২০০৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে অর্থাৎ বৃদ্ধি প্রায় ৩৪২ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসেই (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বিদেশী ঋণ দশমিক শূন্য বিলিয়ন ডলার বেড়েছে, যার মধ্যে সরকার একাই নিয়েছে দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিতডেবট লায়াবিলিটিস টু মেজর ডেভেলপমেন্ট পার্টনারপ্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের ৩৩ শতাংশ বা ১৮ দশমিক ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে, যার সুদের হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থাৎ শতাংশ। -উত্তোলিত অর্থের স্থিতির ওপর বছরে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি, গ্রেস পিরিয়ড বা কিস্তি অব্যাহতি বছর এবং পরিশোধের মেয়াদ ৩০ বছর। এরপরে বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণ পাবে যথাক্রমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ দশমিক ২৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জাপান দশমিক ২১৩, রাশিয়া , চীন দশমিক ৭৬ এবং ভারত বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ৭৪৩ মিলিয়ন ডলার, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ৬৬৪ মিলিয়ন ডলার ঋণ বাংলাদেশকে দিয়েছে। ঋণদাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি), প্রায় হাজার ৪০৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল ঋণের অর্থ প্রায় হাজার ৬১৪ কোটি ২৯ লাখ এবং সুদ হাজার ৭৯৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের আইডিএকে সময় পরিশোধ করা হয়েছে হাজার ৭৫৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, মূল ঋণের অর্থ হাজার ৯৯ কোটি ৫৪ লাখ এবং সুদ হাজার ৬৫৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ছাড়া চীনকে হাজার ৪৫৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, মূল হাজার ৪১০ কোটি ১৭ লাখ সুদ হাজার ৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং জাপানের জাইকাকে হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, মূল ৯২ কোটি ৫৮ লাখ সুদ ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

সাধারণ মানুষের অনেকের ধারণা, সরকার বিদেশীদের কাছ থেকে ঋণ নেয় মানুষের জ্বালানি-বিদ্যুৎ-খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ানোর জন্য। সাধারণ মানুষের এমনটা মনে হওয়ার কারণ বিশ্বব্যাংক আইএমএফের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ভতুর্কি প্রসঙ্গে দেওয়া নানা প্রেসক্রিপশন। এই প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করতে গিয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে। কারণে সরকার যে ঋণের অর্থে বিপুল উন্নয়ন করে, তা জনগণের কাছে গৌণ হয়ে যায়। জন্যই এখন কান পাতলেই শোনা যায়, মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সরকারের উন্নয়নের শাপশাপান্ত করে। বিষয়টির অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, জনশুমারি গৃহগণনা শুমারির সর্বশেষ উপাত্ত অনুসারে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের পরে মাথাপিছু বিদেশী ঋণ ৫৯২ ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৬৯ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৈদেশিক ঋণ মিলিয়ে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ১৯ টাকা। ধারণা করা যায়, প্রায় এক বছর পর এই ঋণ বেড়ে লাখ ২০ হাজার টাকা হয়েছে। সরকার, বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বলছে বাংলাদেশ আরও ঋণ নিতে পারে, আশঙ্কার কিছু নেই। কারণ, সরকারের হিসাবে জিডিপির অনুপাতে বিদেশী ঋণ ১৭-১৮ শতাংশ। তবে অর্থনীতিবিদদের হিসেবে এর পরিমাণ ২৩-২৫ শতাংশের মতো, যার মধ্যে আবার কিছুটা কঠিন শর্তের বিভিন্ন ধরনের ঋণও আছে। সরকার মনে করে জিডিপির ৪০ শতাংশ সমপরিমাণ ঋণ সে নিতেই পারে। তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ঋণ চাইলে বাংলাদেশ কোনো না কোনো মাধ্যম থেকে পাবেই। কিন্তু সমস্যা একটাই, বাংলাদেশকে অন্যের বেড়াজালে থাকতে হবে।

এই যেমন সরকার বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের চেয়ে মনিটরিং কম হওয়ায়, এখন বিভিন্ন প্রকল্পের নামে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছে দ্বিপাক্ষিক মাধ্যমে; রাশিয়া, জাপান, চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ থেকে। এই দেশগুলো সরকারি নীতিব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করলেও অন্যভাবে সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়। উপরন্তু দ্বিপাক্ষিক ঋণে নেওয়া প্রকল্প থেকে রিটার্ন যথাসময়ে না এলে বাংলাদেশ চাপের এক চক্রে পড়ে যাবে। আর এমনটি যে একসময় হবে, তা অনেকটা হলফ করেই বলা যায়। কারণ, ছোট হলেও স্বজনতোষী পুঁজিবাদের সুবাদে স্বাস্থ্য, শিক্ষা অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ প্রতিবছর এমন অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় করে, যা থেকে একটি পয়সাও রিটার্ন আসে না, কবে আসবে তা- কেউ জানে না। ঋণ নিয়ে করা এসব প্রকল্পের চাপ জনগণ অনুভব করতে শুরু করবে ২০২৪-২৫ থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছর পর্যন্ত। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ছাড়াও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াও বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের অন্যতম বড় ঝুঁকি। যেমন- ভারতে ২০০০ হাজার মেগাওয়াটের একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সময়ের আগেই কাজ শুরু করেছে, যেখানে ব্যয় হয়েছে বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশে ২৪০০ মেগাওয়াটের একই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে শুধু ঋণই নেওয়া হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলার। প্রকল্প কবে আলোর মুখ দেখবে তা নিশ্চিত নয়, কিন্তু ইতোমধ্যেই এই ঋণের অর্থ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।

যারা বলেন যে, বাংলাদেশ আরও অনেক বিদেশী ঋণ নিতে পারে, তাদের করজোড়ে নিরুৎসাহিত করতে অনেক উদাহরণই দেওয়া যায়। তবে তাদের সবার আগে স্মরণে রাখা প্রয়োজন, বিপদে-আপদে ঋণ নেওয়া দোষের কিছু না। কিন্তু ঋণ করে ঘি খাওয়াটা দোষের। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে কষ্টে রেখে বিদেশী ঋণে ঘি না খেয়ে রাজস্ব খাতের উন্নয়ন করলে তাদের পক্ষে আরও বেশি ঘি-মাখন খাওয়া সম্ভব, যার কথা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য তার জগৎবিখ্যাত অর্থশাস্ত্রেও স্বীকার করে গেছেন, “রাজকর্মচারী হয়ে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে বসে থাকবেন, এটা অবিশ্বাস্য। জলের নিচের মাছের গতিবিধি যেমন লক্ষ করা সম্ভব নয়, তেমনি রাজকর্মচারীর তহবিল আত্মসাৎ করাও পর্যবেক্ষণ করা অসম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×