ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

স্থিতিশীল নগরায়ণ ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব

মো. সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:২৮, ৬ অক্টোবর ২০২৩; আপডেট: ১১:৩৪, ৭ অক্টোবর ২০২৩

স্থিতিশীল নগরায়ণ ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব

.

স্থান কালভেদে বিশ্বের যে কোনো দেশে নগরায়ণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি বা প্রভাবের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক প্রতিবেশ, আবহাওয়া ও মানুষের জীবনমানের প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে বিধায় নগর বিন্যাসে স্থান কালভেদে স্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

পৃথিবীর নগরসভ্যতা বিকাশে আয়তন ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের ন্যায় দ্রুত বর্ধনশীল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি অঞ্চলের নগরায়ণের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের নগরায়ণের মৌলিক তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এই পার্থক্য সাতক্ষীরা জেলার ৭.২ শতাংশ থেকে শুরু করে ঢাকা জেলার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশে সামগ্রিক নগরায়ণে চিত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, ঢাকা জেলাকে সবচেয়ে বেশি নগরায়ণ করা হয়েছে। এর বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনার অবস্থান। জনসংখ্যার অসমবণ্টনই নগরায়ণের এই পার্থক্য নির্ধারণ করেছে। এর অনেক কারণ থাকলেও মোটাদাগে বলা যায়- নগর ও শহরের আকার, বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থান, উন্নয়নের গতি ও বিন্যাস এবং অবকাঠামো ও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের উন্নয়ন এই পার্থক্যের দেওয়াল গড়ে তুলেছে।

 

নগরায়ণ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা থেকে স্পষ্ট যে, নগরায়ণ হলো একটি প্রক্রিয়া। যার ফলে মূলত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনব্যবস্থা থেকে মানুষের শিল্প ও বাণিজ্যিভিত্তিক শহরের জীবন ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটে। ১৯৫০ সালে অস্ট্রেলিয়ান আর্কিওলোজিস্ট গর্ডন চাইল্ড তার টাউন প্ল্যানিং রিভিউ গ্রন্থে নগরায়ণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে ১০টি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন।

এগুলো হলো-(১) ঘনবসতি থাকবে, (২) কারিগরি ও পেশাজীবী মানুষ থাকবে, (৩) খাজনা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে, (৪) নির্মাণ ও স্থাপত্য থাকবে, (৫) শাসক শ্রেণি থাকবে, (৬) লিখন পদ্ধতি থাকবে, (৭) জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হবে, (৮) উৎপাদন নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা, (১০) দক্ষ কারিগরি কর্মে নিয়োজিত থাকবে। তবে, আধুনিক নগরায়ণের ধারণায় বলা হয়েছে, শহরে প্রত্যেকটি জিনিসের উন্নয়নকে নগরায়ণ বলে। সমাজবিজ্ঞানী কাল মার্কসের মতে, গ্রামীণ সমাজ থেকে নগর সমাজে স্থানান্তরিত হওয়াই হচ্ছে নগরায়ণ।

এমিল ডুর্খেইনের মতে, যান্ত্রিক সংহতি থেকে জৈবিক সংহতিতে পদার্পণই নগরায়ণ। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, নগরায়ণ হচ্ছে প্রথাগত সমাজ থেকে যৌক্তিক সমাজে উত্তরণ। এ্যালান বি. মাউন্ট জয় বলেন, নগরায়ণ হচ্ছে আধুনিকায়নের সূচক। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির চিহ্ন এবং সমগ্র বিশ্ব শুধু নগরায়ণের দিকেই ধাবিত হয়েছে। যেখানে মানুষ শিল্প ও বাণিজ্যিভিত্তিক শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। 

 

এটি সত্য যে, নগরায়ণ বিশ্বের সর্বত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি কার্যকর বাহন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নগরায়ণ জাতীয় অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। যদিও উন্নয়নশীল বিশ্বে নগরায়ণের হার ৪০ শতাংশেরও কম এবং নগর খাত থেকে জিডিপির ৬০ শতাংশেরও বেশি অর্জিত হয়। বাংলাদেশের ন্যায় দ্রুতবর্ধন নগরায়ণে এ খাত জিডিপিতে ৬৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে।

যেখানে এই অবদান ১৯৭২-৭৩ সালের ২৫ শতাংশ থেকে ১৯৯৫-৯৬ সালে ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। উন্নয়নের বিশ্লেষণে বলা যায়, নগরায়ণ সামষ্টিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে গড়ে ওঠা পোশাক শিল্প ও আনুষ্ঠানিক শিল্প খাতে লক্ষ লক্ষ অদক্ষ নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। মেগাসিটি ঢাকায় যে ধরনের অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেখানে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অঙ্গনে সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের কুফলও জাতিকে ভোগ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে অসহনীয় যানজট, নি¤œমানের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, পরিকল্পিত আবাসন ও সড়ক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, নগর বিস্তারে প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট ও জলাবদ্ধতা, সুষ্ঠু পয়ঃ ও বর্জ্যব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা নাগরিক জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

যা আর্থ-সামাজিক সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।  বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ডিস ক্যাবল সংযোগ এবং অশিক্ষিত পরিবহন শ্রমিকদের অহেতুক হর্ন বাজানোর মতো অভ্যাস স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার মতো নাগরিক সেবা ও উপযোগের ওপরও প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করছে। এ সকল খাতের প্রতিটিতে সেবার স্বল্পতা বা অপর্যাপ্ততা এবং সাধারণভাবে অব্যবস্থাপনা সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

 

অন্যদিকে নগরায়ণের সঙ্গে নাগরিক সচেতনতার জাগরণ সৃষ্টি করতে না পারায় পরিবেশগত বিশেষ করে দেওয়াল লিখন, যত্রতত্র পোস্টার ব্যানার সাঁটুনি, গাড়ি পার্কিং, মলমূত্র ত্যাগ শহরের পরিবেশে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাতে জনস্বাস্থ্যে যে ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, সেটি স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত নানান সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। যা উত্তরণে রাষ্ট্রকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এটি নগর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিকৃষ্টতম উদাহরণ। তাই, নগর শোভাবর্ধনের স্বার্থে সময় এসেছে যত্রতত্র পোস্টার ব্যানার টানানো, মূলমূত্র ত্যাগ, উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজানো, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধসহ এই কুসংস্কৃতি থেকে জনগণকে বের করে আনা।

 

নগর অর্থনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, সব নগরে অপরিকল্পিত ও নি¤œমানের অবকাঠামো নির্মাণ। নাগরিকসেবায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মাঝে উন্নয়ন সমন্বয়হীনতা। এর জন্য শতভাগ দায়ী ও অর্থ অপচয়ের আরেকটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশে স্থিতিশীল নগর উন্নয়ন ও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই সংস্কৃতি অন্যতম অন্তরায়।

নগর পরিকল্পনায় সমন্বিত সঠিক ও দূরদর্শী পরিকল্পনা না থাকায় অপ্রত্যাশিতভাবে লক্ষ্য করা যায়- খোঁড়াখুঁড়ি, ভাঙাগড়ার উন্নয়নযজ্ঞ। দেখা যায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে যে সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে, কিছুদিন পর ঐ সড়কটি পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন স্থাপনের জন্য কাটা হচ্ছে। আবার সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা সেই ক্ষত দূর করার জন্য মেরামত করছে। তারপর গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও অন্যান্য পরিষেবা সংস্থাগুলো পর্যায়ক্রমে একই কাজ করে থাকে। অন্যদিকে রয়েছে নি¤œমানের নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের অপসংস্কৃতি। যা অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে না।

এটা জাতীয় অপচয়ের পাশাপাশি স্থিতিশীল নগরায়ণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বাধা সৃষ্টি করছে। অথচ, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নগর উন্নয়ন যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে টেকসই নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করে। টেকসই নগর উন্নয়নের স্বার্থে এ ধরনের অপচয়ের মানসিকতা থেকে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টজনদের বের হয়ে আসতে হবে।

 

বর্তমান সরকার অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। নাগরিকদের ধ্যানে জ্ঞানে প্রয়োগে স্মার্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রসার এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নগর অবকাঠামোগত পরিকল্পনার নকশা প্রণেতা ও বাস্তবায়নে নিয়োজিত প্রকৌশলীবৃন্দের সততা ও দেশপ্রেমে এক্ষেত্রে স্মার্ট নাগরিকের পরিচয় দিতে হবে। এছাড়া, যারা নগর সুবিধা গ্রহণ করছেন, তাদেরকেও নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে হবে স্মার্টভাবে। সড়ক ব্যবহারে ট্রাফিক আইন শতভাগ মেনে চলার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে হবে। অপ্রয়োজনে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের মানসিকতা পরিহার করে মেট্রোরেল ও পাবলিক পরিবহন ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে হবে। এতে অসহনীয় নগর যানজট দূরীকরণে সহায়ক হবে।

 

চলমান শতাব্দীকে বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের শহর ও গ্রাম উভয় অঙ্গনে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক  প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের নগর অঞ্চলগুলো এখন উন্নত বিশ্বের বৈশ্বিক নগরীর প্রান্তিক বলয় হিসেবে কাজ করছে। কারণ, নগরগুলোতে স্থাপিত শিল্প উৎপাদিত পণ্য বিশ্ববাজারে প্রবেশ করছে। সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। যা জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখে।

অন্যদিকে, এর বিরূপ প্রভাবও রয়েছে। দ্রুত বর্ধনশীল নগরাঞ্চলে ধনিক শ্রেণি শুধু শিল্প স্থাপন করছে না। তারা আবাসন শিল্প, পর্যটন কেন্দ্রও নির্মাণ করছে। এসব করতে গিয়ে তারা শহরের নি¤œাঞ্চল, নদী-খাল-বিল ভরাট করছে। পাহাড় কেটে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এর ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মূল্যবান কৃষি জমি হ্রাসের পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাধার কমে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম বন্যা ও জলাবদ্ধতা। হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির ফল ও মৎস্য। শিল্পবর্জ্য অপরিশোধিত নিষ্কাশনের ফলে দূষিত হচ্ছে পানি। বাড়ছে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। এর সবই স্থিতিশীল নগর বিকাশ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায়। আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য সুষ্ঠু নগর বসতি গড়ে তুলতে সকল অনাসৃষ্টি পরিহার হোক বিশ্ব বসতি দিবসের অঙ্গীকার।

 

আমরা কিভাবে আগামীকে মূল্যায়ন করব, সেটির ওপর নির্ভর করে বর্তমান পরিকল্পনা। এখানে দূরদৃষ্টির ঘাটতি থাকলে শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয়, অনাগত প্রজন্মকেও তার মাশুল দিতে হবে। আমাদের পূর্বসূরিরা যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ করেছে, কিংবা অবকাঠামো গড়ে দিয়েছে, সেটির কুফলের মাশুল আমরা দিচ্ছি।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে রাজধানী ঢাকা মেগাসিটি হওয়া সত্ত্বেও বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবে বিশ্বে চিহ্নিত। এই অপরিকল্পিত নগরীকে বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় করার জন্য বর্তমান সরকার অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বহুমাত্রিক ফ্লাইওভার চালু হয়েছে। কিন্তু এরপরও নাগরিক জীবনে স্বস্তি আসছে না।

এই অস্বস্তির পেছনে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে যেমন ভুল নকশার দায় রয়েছে, তেমনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না করার ব্যর্থতা রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাতরাস্তা-কাওরানবাজার-মগবাজার-বাংলামোটর-মৌচাক-মালিবাগ-শান্তিনগর ফ্লাইওভার, বিজয় সরণি-তিব্বত ফ্লাইওভার, মহাখালী ফ্লাইওভারের নির্মাণ নকশার ত্রুটির কারণে সুফল নিশ্চিত করা যায়নি।

এখনো মগবাজার মোড়, বেইলি রোড ক্রসিং, তিব্বত ক্রসিং, মহাখালী ক্রসিং, সোনারগাঁও মোড়ে অসহনীয় যানজটে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ক্ষয় হচ্ছে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা, অপচয় হচ্ছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি। সম্প্রতি বহুল প্রত্যাশিত বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অবমুক্ত করা হয়েছে। সবার প্রত্যাশা ছিল এই মেগাপ্রকল্প অসহনীয় যানজট কমাবে।

 

কিন্তু বাস্তবে ইন্টার সেকশনগুলোতে ট্রাফিক জ্যাম বেড়েছে। বিশেষ করে ফার্মগেট ও বনানীতে। এই মেগাপ্রকল্পের নকশা প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের অবশ্যই এ ধরনের পরিস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে র‌্যাম্প এলাকার ট্রাফিক মোকাবিলায় সংলগ্ল এলাকার ইন্টারসেকশনগুলোতে ছোট ছোট ওভারপাস নির্মাণের ধারণা দেওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে উত্তরার হাউজবিল্ডিং থেকে দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল স্টেশন পর্যন্ত সোনারগাঁও জনপথ সড়কটি মেট্রোরেল মতিঝিল পর্যন্ত চালু হলে গাড়ির চাপ নিতে পারবে কিনা, বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে হাউজবিল্ডিং এলাকার ইন্টারসেকশনের বহুমাত্রিক গন্তব্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

যা অদূর ভবিষ্যতে মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্পের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করার শঙ্কা রয়েছে। এরূপ উদাহরণ অন্যান্য মহানগর ও নগর উন্নয়নে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ যেহেতু ব্যয়বহুল, তাই নতুন নগরায়ণের ক্ষেত্রে ইন্টারসেকশনগুলোর যানজট নিরসনের বিষয়টি মাথায় রেখে ইউলুপ পদ্ধতি অনুসরণ করে নগর পরিকল্পনা গ্রহণে মনোযোগ দিতে হবে। নগর অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

 

বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রযুক্তি ব্যবহার বেড়েছে। এই প্রযুক্তিকে সচল রাখার জন্য জ্বালানি জোগান দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কার্বন নিঃসরণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক জলবায়ুতে। দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এর বিরূপ প্রভাবে আমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাত্রারিরিক্ত গরম পড়া অতীতের সব রেকর্ডকে ভঙ্গ করছে। আগামীদিনে এই মাত্রা আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

 

তাই, নগরায়ণের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় নবায়নযোগ্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি বৃক্ষায়ন ও প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষায় মনোযোগ বাড়াতে হবে। নচেৎ এ ধরনের পরিবেশ জনস্বাস্থ্যে যে ধরনের ঝুঁকি ফেলবে, তা মোকাবিলা করা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

ইতোমধ্যে ফোন কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক বিস্তারে টাওয়ার রেডিশনের কারণে ক্যান্সারের ন্যায় মরণঘাতী বিস্তার হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ফলদ ও মৎস্যসম্পদ। যা শুধু নগর অর্থনীতি নয়, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতি চাপ ফেলছে। নি¤œ আয়ের মানুষের পরিবারকে নিঃস্ব করছে। নগরায়ণে আবহমান প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী-বিল-খাল-পুকুরগুলো সংরক্ষণ রেখে বনায়নকে উৎসাহিত করে পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প আমাদের নেই। আশা করি, সংশ্লিষ্ট অংশীজন বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করবেন। সেটাই প্রত্যাশা।

 লেখক : সহকারী প্রকৌশলী, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আইডিইবি

×