ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

প্রতিবেশগত সংরক্ষিত এলাকা

আলম শাইন

প্রকাশিত: ২২:৩২, ১ অক্টোবর ২০২৩

প্রতিবেশগত সংরক্ষিত এলাকা

.

মানুষের নানা কর্মকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাময় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকেপ্রতিবেশগত সংকটাপন্নএলাকা বোঝায়। সহজ বাংলায় পরিবেশ অথবা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হলে ওই এলাকাকেপ্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাবলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয়ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’- সংক্ষেপেইসিএ যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে শব্দগুলো ব্যাপক পরিচিত। অন্যদের কাছেও যে শব্দটি অপরিচিত তা কিন্তু নয়। শুধুমাত্র বোঝার ব্যাপারটায় অনেকে গোলমাল বাঁধিয়ে ফেলেন, অন্য কিছু নয়।

আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের ৮টি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও ৪টি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে- সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা), সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকা বেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদী, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী গুলশান-বারিধারা লেক। বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা -এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে। ব্যাখ্যা দেওয়া আছে- কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যৎসামান্য তথ্য নি¤œ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

প্রথমে সুন্দরবনের কথায় আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। ধরনের শ্বাপদসংকুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য দুই বাংলা ছাড়া বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা বন। সুন্দরবন বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হিসাবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে যে কেউ ইচ্ছে করলেই অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন করতে পারছে না। তাতে করে মৎস্য সম্পদ বৃক্ষরাজি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের সার্কেল সুরক্ষিত হচ্ছে।

সিলেটের হাকালুকি হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠা পানির জলাশয়। এতদাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয় লোকদের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে অত্র অঞ্চলে কেউ মর্জি মোতাবেক সম্পদ বিনষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না আগের মতো। কক্সবাজার-টেকনাফের উপদ্বীপে বন্যপ্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় দুটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাতে করে সামুদ্রিক প্রাণী জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।

সেন্টমার্টিন সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে দুটি দ্বীপকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে শনাক্ত করা হয়ছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি টার্টলের (জলপাইরঙা কাছিম) প্রজননস্থল। এছাড়াও সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুঁটো বাটানের আবাসস্থল। অপরদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য রয়েছে। পরিবেশগত কারণে এই দীপটিও ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশেষ করে দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন- পলিথিন, কোমল পানীয়ের বোতলসহ নানা আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অপরদিকে পর্যটকদের রাতযাপন কিংবা আয়েসের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে করে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্টমার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ছে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাতযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে।

অপরদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদী, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী গুলশান-বারিধারা লেক অসনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানা নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন গৃহস্থালির আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জল বিবর্ণ হয়ে এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় মাছ মারা যাচ্ছে, স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। ফলে সরকার সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করেছে এলাকাগুলোকে।

দেশে ধরনের আরও কিছু সংকটাপন্ন এলাকা রয়েছে। তার মধ্যেচলনবিল’ ‘আড়িয়লবিলঅন্যতম। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেগুলোও সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষিত হবে একদিন। শুধু দুটি বিলই নয়, দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় কিংবা বন-বনানী রয়েছে, সেসব এরিয়াকে অতি সত্তরপ্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাহিসাবে ঘোষণা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বলে নেওয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়। আমাদের ঘাড়েও বর্তায়, যা সবার মনে রাখতে হবে। কারণ দেশের পরিবেশ জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবারই। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হবে। বলে নেওয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এই সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত। সুতরাং সকলের জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উদ্দাম গতিতে কাজ করা উচিত।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যম প্রয়োজন। আর সেই উৎকৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাই আমরা ইচ্ছে করলে সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখতে পারি। পাশাপাশি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি। নিজের উদ্যোগে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়ে দেশকে সবুজ সমাহারে ভরে তুলতে পারি। এখানে শুধু ইচ্ছা শক্তিটাই যথেষ্ট। তাই বিষয়ে কাজ করতে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আসুন ফেসবুকে বেশি সময় না কাটিয়ে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজ বিশ্ব গড়ে তুলি নিজ দায়িত্বে। তবেই তো সবুজ গ্রহটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারবে, সেই সঙ্গে আমরাও বেঁচে থাকার যথাযথ উপাদান পেয়ে যাব। বুকভরে শ্বাস নিতে পারব। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক নিরাপদ ভূখন্ড উপহার দিয়ে যেতে পারব।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

পরিবেশ কর্মী