ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাক-নির্বাচন ভাবনা ও প্রত্যাশা

নূরুর রহমান খান

প্রকাশিত: ২০:৫২, ১ জুন ২০২৩

প্রাক-নির্বাচন ভাবনা ও প্রত্যাশা

নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য মাস ঘোষণা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্দেশ্যে নিরলস কাজ করছে

১৯৩৭-এর আগে বঙ্গীয় পরিষদ ছিল রায়বাহাদুর- খান বাহাদুর, জমিদার-ব্যারিস্টারদের মিলনকেন্দ্র। ’৩৭-এ বঙ্গীয় পরিষদে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। রাজপ্রতিনিধিদের স্থানে গণপ্রতিনিধিরা স্থান করে নেন। বিভাগোত্তরকালে নির্বাচিত  নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু বর্তমানে সংসদ যেন পূর্বাবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। খান বাহাদুর-রায়বাহাদুরদের স্থান দখল করেছে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। তাদের দাপটে রাজনীতিবিদ বা প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বর্তমান পদ্ধতিতে সৎপথে অর্জিত অর্থে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রায় অসম্ভব। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এ জন্য চাই ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সহযোগিতা। আবার শিল্প কিংবা ব্যবসা চালু রাখতে হলে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক কর্ণধারদের শরণাপন্ন অপরিহার্য। তারা পরস্পরের পরিপূরক। শিল্পপতি-ব্যবসায়ী এবং তথাকথিত রাজনীতিবিদদের মেলবন্ধন অপূর্ব!

নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য মাস ঘোষণা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্দেশ্যে নিরলস কাজ করছে। এজন্য ইসি নিশ্চয়ই ধন্যবাদার্হ। ইসির প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য গ্রহণযোগ্য বিতর্কহীন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। এক্ষেত্রে বড় দলগুলোর, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মুখ্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ বিষয়ে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতাবহির্ভূত অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো যাতে নির্বিঘেœ তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে পারে সেদিকে ইসির সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারি দল প্রশাসনকে ব্যবহার করে যাতে গণতন্ত্রকে কলুষিত করতে না পারে সেক্ষেত্রেও ইসির ভূমিকা রয়েছে।

স্বাধীনতাবিরোধী, তাদের সমর্থক ও সমর্থিত দল ব্যতীত অন্য দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিগত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকা ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের অত্যুৎসাহী কর্মীরা প্রশাসনের নাকের ডগায় অনাকাক্সিক্ষত পন্থা অবলম্বন করেছে। তেমনি ক্ষমতাপ্রত্যাশী প্রধান বিরোধী দল স্বাধীনতাবিরোধীদের নিজ দলে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের দু-চারজন দাঁড়িপাল্লা হাতে মাথায় ধানের আঁটি নিয়ে ‘আল্লা আল্লা’ করতে করতে নির্বাচনী বৈতরণী পারও হয়েছেন। এবার তাদের অনেকে পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারের ধান্ধায় আছেন। আলখাল্লার ভেতরে দাঁড়িপাল্লা গুটিয়ে ধানের আঁটি বগলে নিয়ে নৌকার সওয়ারি হওয়ার খোয়াব দেখছেন। নৌকার কা-ারি বড্ড তেড়িয়া, বাপ্কা বেটি। তাঁর শ্যেনদৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া দুঃসাধ্য। তবু বলা যায় না।

দলে এদের জন্য সুপারিশ কিংবা তদ্বির করার লোকের অভাব না-ও হতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর দুঃসময়ের বিশ্বস্ত সুহৃদ তাজউদ্দীন আহমদকে এদের চক্রান্তেই বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। বাঙালির স্বার্থবিরোধীদের অন্যতম এবং বাংলা ভাষার চিরশত্রুÑআরবি হরফে বাংলা লেখার প্রধান পুরোহিতের উত্তরপুরুষ যদি আওয়ামী লীগ কিংবা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও নিত্যসঙ্গী হন তাহলে কা-ারির কা-সহ মু-সহ, ছেদনের কোনো সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। এরাই চিরকালীন মীর জাফর, বর্তমানের মোশতাক।
নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলকে চাপে রেখে ফায়দা হাসিলের খেলা বহু পুরাতন। এতে অনেক সময় ফেরেব্বাজদের মনোবাঞ্ছা পূরণও হয়। এরই মধ্যে এই আলামত দৃশ্যমান। হেফাজতের তসবিহ নিয়ে কতিপয় ‘মাও’ খেতাবধারী ‘মেঁও’ ধর্ষক মামুনুল হক ও তাদের কয়েকজন অনুসারীর মুক্তি দাবি করে কর্মসূচি ঘোষণার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। পবিত্র মসজিদকে তারা দুর্গ হিসেবে ব্যবহারের পাঁয়তারা করছে। ধর্ষক মামুনুলকে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট থেকে পরকীয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যত্রও তার রক্ষিতার সন্ধান পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগে হেফাজতিরা বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভুল বুঝিয়ে ঢাকায় জড়ো করেছিল।

এদের অনেকেই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অভিভাবকদের অগোচরে সরকার পতনের লক্ষ্যে তাদের ঢাকায় সমবেত করা হয়েছিল। সরকারের সময়োচিত কঠোর অবস্থানের ফলে ‘মেঁওদের’ দুরভিসন্ধি ভেস্তে যায়। এতদিন নিশ্চুপ থেকে নির্বাচনের সময়টাকে তারা অপকর্মের সুবর্ণ সুযোগ মনে করছে। এবার যদি অতীতের পুনরাবৃত্তির চেষ্টা করে তাহলে সরকারও নিষ্ক্রিয় থাকবে না। সাধারণ মানুষও তাদের প্যাঁদাতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করবে না।
নির্বাচনের প্রধান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষÑ ক. নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠান বা পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে; খ. নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এবং গ. নির্বাচকম-লী- নির্বাচনে যাদের গুরুত্ব সর্বাধিক আর নির্বাচন পরবর্তীকালে যারা শুধু গুরুত্বহীন নন, নির্বাচিতদের নিকট প্রায় অপাঙ্ক্তেয়-করুণার পাত্র। নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিটি দলের কর্মসূচি বা মেনিফেস্টো ভোটার অর্থাৎ জনগণের উদ্দেশে উপস্থাপন করা হয়। দলীয় কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি দেখে সাধারণ মানুষের ভোটদানে আগ্রহ বাড়ে। ভোটপ্রত্যাশী দলগুলোকে ভোটারদের দাবিও বিবেচনা করতে হবে।

ধর্মীয় লেবাসধারী এবং ক্যান্টনমেন্টপ্রসূত দলগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। ধর্মান্ধরা দেশকে অন্ধকার থেকে গাঢ়তর অন্ধকারেই নিয়ে যাবে। আর ক্যান্টনমেন্টজাত দলের হাত রক্তে রঞ্জিত। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার উদ্দেশ্যে এরা কতটা নির্মম নিষ্ঠুর হতে পারে জিয়া-এরশাদ এর নিকৃষ্ট উদাহরণ। এদের আমলে শুধু সন্দেহবশত বিভিন্ন সেনানিবাসে শত শত সৈনিক অফিসারকে বিনা বিচারে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছে। ’৭৭-এ জাপানি এয়ারলাইনসের অঘটনকে পুঁজি করে একটি দেশের প্রশিক্ষিত বিমান বাহিনীকে ব্যক্তিস্বার্থে সম্পূর্ণ পঙ্গু করার ইতিহাস এখন আর অজানা নয়। জাতির তথা দেশের দুর্ভাগ্য, পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও এদের বিচার হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের মতো এদেরও বিচার হওয়া উচিত ছিল। এখনো তদন্ত হতে কোনো বাধা নেই। প্রয়োজন সদিচ্ছা ও সৎসাহস। এখনো ফাঁসির দ-প্রাপ্ত একাধিক যুদ্ধাপরাধীকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। কারণ অজ্ঞাত। জিজ্ঞাস্য, কোন মচ্ছবে এদের উৎসর্গ করা হবে?
আমরা সেসব দল বা জোটকে ভোট দেব যারা নিম্নোক্ত দাবিসমূহ মেনে নেবেÑ 
১। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান পুনর্বহাল। 
২। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রেখে গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রাখা। 
৩। বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে নিশ্চয়তা প্রদান। এক্ষেত্রে কোনোক্রমেই প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। 
৪। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৫। ভোটারদের নিরাপত্তা প্রদান এবং ভোট কেন্দ্রের প্রতিটি বুথে পর্দার অন্তরালে অবাঞ্ছিত ঘটনা রোধ করার জন্য অবশ্যই সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা। 
৬। দলীয় বা ব্যক্তিস্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী  বাহিনীর ব্যবহার রহিত করা। 
৭। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের পরে উপস্থিত দলীয় এজেন্টদের সামনে ভোট গণনা করে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রে ফল ঘোষণা। 
৮। ‘বিজয়ী হলে ফল গ্রহণযোগ্য, পরাজিত হলে অগ্রহণযোগ্য’ অর্থাৎ ফল প্রত্যাখ্যানের মনোবৃত্তি পরিহার করতে হবে। 
নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রেখে ফল প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতার রদবদল গণতন্ত্রের অন্যতম বাস্তবতা। দলীয় কর্মকা- বিচার-বিবেচনা করেই ভোটার তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। তাঁরাই নির্বাচনের ফলের নিয়ামক।  অকারণে ভোট বর্জন, ফল প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি প্রকারান্তরে ভোটারদের অপমানের শামিল। রাজনৈতিক দলের কর্ণধারদের এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে এবং দলীয় কর্মীদেরও তা বোঝাতে হবে। 
কোটা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা এবং বাস্তবতা পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল এখন তা নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য সর্বক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বা আসন সংরক্ষণ প্রথা ছিল অপরিহার্য এবং তার উপযোগিতাও ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু তা বংশপরম্পরায় বা যুগ যুগ ধরে চলতে পারে না। এ বিষয়টি বিচার-বিবেচনার সময় এসেছে। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের সম্মানিত চেয়ারম্যান মৌখিকভাবে জানালেন, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এখন আর ‘কোটা সিস্টেম’ নেই। 
জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত। তাঁরা পরোক্ষভাবে নির্বচিত তথা সংখ্যানুপাতে বিভিন্ন দল থেকে মনোনীত হয়ে থাকেন। জনগণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ক্ষীণ এবং তাঁদের ঠিক জনপ্রতিনিধিও বলা যায় না। মনোনীত মহিলা সংসদ সদস্যদের যোগ্যতার মাপকাঠি মন্ত্রী-এমনপিদের স্ত্রী, কন্যা, বোন কিংবা বিশেষ পরিবারের সন্তান বা সদস্য হিসেবে। ব্যক্তিক যোগ্যতা সেখানে গৌণ। যে দেশের তিনটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান মহিলা, প্রধানমন্ত্রী, সংসদের উপ-প্রধান, একাধিক মন্ত্রী, সর্বোপরি স্পিকার মহিলা, উচ্চ আদালতের একাধিক বিচারপতি, সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মহিলারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে  কাজ করছেন সে দেশের জাতীয় সংসদের মহিলাদের জন্য ‘সংরক্ষিত আসন’ সমর্থনযোগ্য নয়।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অর্থাৎ উপজাতি অথবা অনগ্রসর গোষ্ঠী বা প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমানে মহিলাদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এতে তাঁদের অসম্মান বা মর্যাদাকে ক্ষুণœ করা হয়। মহিলাদের আসন সংরক্ষণের বিকল্প হিসেবে প্রত্যেক দল থেকে অন্তত ১৫% মহিলাকে মনোনয়ন দান বাধ্যতামূলক করা হলে ৩০০ আসনে অবশ্যই ৪৫ জন মহিলা থাকবেন। এর বাইরে যে কোনো মহিলা বা নেত্রী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। ফলে অনেক দলেই মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি এবং জাতীয় সংসদে মহিলা সদস্যদের সংখ্যা ৭০/৮০ পর্যন্ত হতে পারে। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের ভূমিকাও যথেষ্ট বলিষ্ঠ। কেউ তাদের করুণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখবেন না। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটা সম্ভব হবে না। এজন্য সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন।

আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ জোটসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল তাদের নির্বাচনী কর্মসূচি বা মেনিফেস্টোতে যেন এ বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রশ্ন উঠতে পারে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ জাতীয় সংসদের সদস্য/সদস্যা সংখ্যা (৩০০+৫০) ৩৫০। নির্বাচনী এলাকা ৩০০। এটি কোনো সমস্যাই নয়। নির্বাচনী এলাকা ৩০০-এর পরিবর্তে ৩৫০ করলেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। 
সম্প্রতি এক মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সচিব ও যুগ্ম সচিবের বেয়াদবি ও ধৃষ্টতার ঘটনা মন্ত্রণালয়ে আলোড়ন  সৃষ্টি করেছে। বেশ কয়েক বছর যাবৎ এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আমলাতন্ত্র প্রতিপদে মন্ত্রী-এমপিদের  অগ্রাহ্য করার মতো ধ্রষ্টতা দেখাচ্ছে। সরকার দুর্বল হলে হনুমানের লেজও মোটা হয় এবং তারা যত্রতত্র লম্ফঝম্প করে। স্বাধীনতা উত্তরকালে কোনো এক মন্ত্রী তাঁর অবাধ্য সচিবের টাই ধরে টানতে টানতে নিজ কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। সংবাদটি তখন পীড়াদায়ক মনে হলেও এখন ভাবছি মন্ত্রী মহোদয় যথার্থ কাজটিই করেছিলেন। আমলারা ভুলে যায় তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী আর মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সরকারের  দুর্বলতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্য মন্ত্রী ও স্বল্পশিক্ষিত এমপিদের কারণে আমলাতন্ত্র আস্কারা পেয়ে সীমা লঙ্ঘনের দুঃসাহস দেখায়। আশা করি সরকার মন্ত্রীদের দায়িত্ব দেওয়ার আগে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার বিষয়টি বিবেচনা করবে। জনপ্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। 
সরকার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘পেনশন স্কিম’ ও ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ চালু করে একটি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যেসব চাকরিজীবী সাহস ও সুযোগের অভাবে সৎ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন অবসর গ্রহণের পর তাঁদের বেঁচে থাকার অবলম্বন সরকারের এই পদক্ষেপ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকার পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে অবসরপ্রাপ্তদের প্রায় ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নেওয়ার অবস্থা। অবসরোত্তরকালে তাদের জীবনে কিছুটা স্বস্তিদানের জন্য সরকারের  নিকট জোর দাবি, পেনশন স্কিম ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ যেন আগের মতোই রেখে অনতিবিলম্বে তা কার্যকর করা হয়।

ইতোমধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের সংবাদ ফাঁস হয়েছে। সেগুলো ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি বন্ধ করলে পেনশন স্কিম ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ কমানোর প্রয়োজন হবে না। সুখের বিষয়, সরকার ৯০ বছর বা ততোধিক বয়ঃবৃদ্ধদের জন্য বয়স্কভাতা প্রদানের চিন্তা-ভাবনা করছেন। স্মর্তব্য, বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর।
১৯৩৭-এর আগে বঙ্গীয় পরিষদ ছিল রায়বাহাদুর- খান বাহাদুর, জমিদার-ব্যারিস্টারদের মিলনকেন্দ্র। ’৩৭-এ বঙ্গীয় পরিষদে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। রাজপ্রতিনিধিদের স্থানে গণপ্রতিনিধিরা স্থান করে নেন। বিভাগোত্তরকালে নির্বাচিত  নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু বর্তমানে সংসদ যেন পূর্বাবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। খান বাহাদুর-রায়বাহাদুরদের স্থান দখল করেছে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীগোষ্ঠী। তাদের দাপটে রাজনীতিবিদ বা প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বর্তমান পদ্ধতিতে সৎপথে অর্জিত অর্থে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রায় অসম্ভব। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এজন্য চাই ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সহযোগিতা। আবার শিল্প কিংবা ব্যবসা চালু রাখতে হলে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক কর্ণধারদের শরণাপন্ন অপরিহার্য। তারা পরস্পরের পরিপূরক।

শিল্পপতি-ব্যবসায়ী এবং তথাকথিত রাজনীতিবিদদের মেলবন্ধন অপূর্ব!  এ দেশের প্রচলিত প্রবাদটি এক্ষেত্রে অভ্রান্ত- ‘চোরে চোরে হালি/এক চোরে বিয়া করছে আরেক চোরের শালি।’ সংসদ প্রকৃতপক্ষে আইন পরিষদ। সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ  আইন প্রণয়ন এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। এছাড়াও বাজেট উপস্থাপনসহ বহুবিধ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ তাঁরাই করেন। সেজন্য সংসদে বিজ্ঞ আইনজীবীসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি অপরিহার্য। সংসদের মর্যাদা রক্ষাও প্রয়োজন। সংসদে ১০% ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি, ২০% আইনজীবী এবং বাদবাকি ৭০%-এর মধ্যে বিশিষ্ট চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, কৃষি বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাংবাদিক, ঝানু কূটনীতিক, রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ে অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রমুখের উপস্থিতিতে একটি সমৃদ্ধ জাতীয় সংসদ গঠিত হতে পারে। 
গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সরকার গঠনের লক্ষ্যে অবশ্যই স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী বৈতরণী উত্তরণে তাদের নৌকাই একমাত্র ভরসা। ধর্ম ব্যবসায়ী এবং  স্বৈরাচারের ধারক ক্যান্টনমেন্টজাত দল ব্যতীত সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক নৌকার সওয়ারি হতে পারবেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগকে তাদের জোটভুক্ত দলগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ৫০টি আসন রেখে ২৫০টি আসনে নিজেদের প্রার্থী দিতে হবে।

এর মধ্যে অন্তত ১৭৫ থেকে ২০০ আসনে বিজয়ী হতে পারেন এমন প্রার্থীর মনোনয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই তৃণমূল কর্মীদের সমর্থনই মনোনয়নের একমাত্র মাপকাঠি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের অনুভূতি কিংবা সেন্টিমেন্টকে অগ্রাহ্য করে অর্থবিত্ত অথবা আত্মীয়তার জোরে ওপর থেকে প্রার্থী চাপিয়ে দিলে সেটা হবে আত্মঘাতী। ফলে ভরাডুবি থেকে দলকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, কলঙ্কিত মন্ত্রী-এমপিদের বাদ দিয়ে তৃণমূল সমর্থিত নতুন মুখ এমপি পদে মনোনয়ন দান সময়ের দাবি। 
জাতীয় সংসদকে প্রাণবন্ত করবার জন্য সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল অপরিহার্য। শুধু বিরোধিতার জন্যই বিরোধী দল নয়, সততা, জনপ্রিয়তায় তাঁরা যদি নির্বাচিত হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলে সরকারও উপকৃত হবে। তাঁদের আলোচনা-সমালোচনায় সরকার পথভ্রষ্ট হবে না। সরকারের ভুলত্রুটি শনাক্তকরণের দায়িত্ব বিরোধী দলের। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সমর্থ হলে সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁরাও সম্মানিত হবেন। বিরোধী দল যাতে যথার্থ ভূমিকা পালনে সমর্থ হয় সে পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকেও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্পিকার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন। 
অতীতে বারবার জাতির ভাগ্যে কলঙ্ক লেপন করেছে একটি ক্ষমতালোভী রক্তপিপাসু বর্বরগোষ্ঠী। সে কথা স্মরণে রেখে বর্তমানে এমন প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তির দুঃসাহস কেউ না করে। ’৭৫-এ পৃথিবীর অন্যতম ঘৃণ্য নারকীয় ঘটনা ছিল জাতির পিতার নির্মম হত্যাকা-। তখন যদি মাত্র দশ হাজার প্রতিবাদী মানুষ একযোগে রাস্তায় বেরিয়ে আসত, তাহলে খুনিরা পালানোর পথ পেত না, এক এগারোর মতো অনির্বাচিত পাশবিক শক্তি সুশীলবাবুদের মতো শকুনি মামাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করতে সমর্থ হতো না, ঘটত না ২১শে’র গ্রেনেড হামলার মতো পৈশাচিক ঘটনা।

সুতরাং স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে এমনভাবে সংগঠিত ও প্রস্তুত থাকতে হবে যাতে এ ধরনের বর্বরতার আভাস পাওয়া মাত্র রাজধানীতে লক্ষ লক্ষ প্রতিবাদী মানুষ বেরিয়ে  আসতে পারে। এ প্রস্তুতি চট্টগ্রাম, বগুড়া, যশোরসহ বিভিন্ন শহর, এমনকি সব জেলা-উপজেলা পর্যায়েও থাকতে হবে। আমরা যেন বিস্মৃত না হই জিয়া-এরশাদের উত্তরসুরিরা সংঘবদ্ধ ও সক্রিয়। তাদের মূল শক্তি পাকিস্তানপন্থি জামায়াত। নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান আলোচনা সুবিধাভোগী স্তাবকদের মর্মপীড়ার কারণ হলেও স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে সুনিশ্চিত। 

লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×