ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

অপচয় ও বিলাসিতা নিয়ন্ত্রণ জরুরি

শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৮ মার্চ ২০২৩

অপচয় ও বিলাসিতা নিয়ন্ত্রণ জরুরি

শামীম আহমদে

সারাবিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন বেসামাল। এই পরিস্থিতির আশু উন্নতি হবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। ন্যাটোর নানা সদস্য রাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে। চীনও এখন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকার পর সবচেয়ে শক্তিশালী রাশিয়া ও চীনের একজোট হওয়া একটি বড় ঘটনা। অন্যদিকে ভারত প্রকাশ্যে না হলেও পরোক্ষভাবে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে।

এই তিন দেশ মিলে জনসংখ্যা প্রায় ৩০০ কোটি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে আছে ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানিসহ অনেকে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে তাদের চাহিদামতো ১ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা দখল করে নিয়েছে। সব মিলিয়ে শান্তি বহু দূরের বিষয় মনে হচ্ছে

আজ তিনজন শেলীর গল্প করা যাক। প্রথমেই মনে করিয়ে দিই ফ্রাঙ্কেস্টাইনের কথা। মনে আছে? সেই মৃত ব্যক্তি যার ভেতর আছে জীবনীশক্তি, তার স্রষ্টা ছিল মেরি শেলী। মাত্র ১৮ বছরে লেখা শুরু করে ২০ বছর বয়সে ফ্রাঙ্কেস্টাইন লেখা শেষ করেন তিনি। ধারণা করা হয় এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকসান। মৃতদেহে জীবন ফিরিয়ে দিয়ে যে নতুন প্রজাতির জন্ম সেই ধারণার সূত্রপাত ১৮২০ সালের দিকে করা একটা বিপ্লবী ব্যাপার ছিল বটে।

তবে এই বইয়ে মেরির স্বামী এবং একাধিক এডিটরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যাই হোক, মেরি শেলী সেই এতদিন পূর্বে, এমনকি একটি অসামান্য বই লিখে শতাব্দী ধরে মানুষের মনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন। এবার আলাপ করা যাক দ্বিতীয় শেলী নিয়ে। পারসি বিস শেলী হচ্ছেন একজন প্রধান ইংরেজ কবি যিনি মেরি শেলীর সঙ্গে প্রায় একই সময়ে বেঁচে ছিলেন। তবে মেরি শেলী মারা যান ১৮৫১ সালে, পারসি শেলী মারা যান ১৮২২ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে, যখন অন্য শেলী মাত্রই ফ্রাঙ্কেস্টাইন প্রকাশ করেছেন।

শেলী জীবিত অবস্থায় বাংলার কবি জীবনানন্দের মতোই হতভাগা ছিলেন। কবি হিসেবে তার জনপ্রিয়তা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা কোনোটাই তিনি দেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা ও সমালোচনা উভয়ই বাড়তে থাকে। একবিংশ শতাব্দীতে তাকে রোমান্টিকতার অন্যতম শীর্ষ কবি হিসেবে রবার্ট ব্রাউনিং বা থমাস হার্ডির সঙ্গে তুলনা করা হলেও এর আগের শতকে আবার তার কবি হিসেবে অবদান নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। শেলী কবিতার ভাষা ও ব্যাকরণে অনবদ্য অবদান রেখেছেন। কিন্তু বদ মেজাজের জন্য তাকে সেই সময় অনেকে ‘ম্যাড শেলী’ বা পাগল শেলীও বলত।

শেলী তার নাস্তিকতা, সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্য বেশ কঠিন সময় পার করেছেন এবং জীবনের শেষ চার বছর তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে ইতালিতে চলে যান এবং সেখানেই ১৮২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মজার ব্যাপার প্রথম যে শেলী নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করছিলাম সেই শেলী ছিলেন এই শেলীর দ্বিতীয় স্ত্রী। অনেকে ধারণা করেন ফ্রাঙ্কেস্টাইন রচনার ধারণা মেরি শেলী হয়ত পারসি শেলীর থেকেই পেয়েছিলেন। অনেকে এও ধারণা করেন যে, পারসি শেলী ফ্রাঙ্কেস্টাইন রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

তবে ফ্রাঙ্কেস্টাইন রচনায় তার ভূমিকা অজ্ঞাত থেকে গেলেও ১৮১৮ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ইতালিতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা অবস্থায় পারসি শেলী বিশুদ্ধতম কিছু কবিতা রচনা করেন, যা তাকে অমরত্ব দিয়েছে। তৃতীয় শেলীকে তেমন কেউ চেনে না। তিনি বাংলাদেশের হাওয়া, জল খেয়ে বড় হওয়া মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স করে স্বামী-সন্তানদের যতœ ও নিজের পরিবারকে গুছিয়ে তুলতে সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন। অত্যন্ত সুন্দরী এবং শালীন, ধর্মপ্রাণ এই শেলী হচ্ছেন আমার সেজো চাচি।

শেলী চাচি সম্প্রতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। তার চিকিৎসা চলছে। ১২ দফা কেমোথেরাপি দিয়ে সেই ক্যান্সারের ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করা হয়েছে। আমি যখন ২০০৬ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথে ফুল স্কলারশিপে এমপিএইচ করছি তখন সেখানে আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ইলিয়াস ভাই ও আজিজ ভাই। ইলিয়াস ভাই পরবর্তীতে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন ও ট্রপিকাল মেডিসিন থেকে পিএইচডি করে, সৌদি আরবের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শেষ করে এখন যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্যে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অন্যদিকে আজিজ ভাই অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে এখন সেখানেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। এমপিএইচ করার আগে আজিজ ভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু মূলত ক্যান্সার ও ধূমপানজনিত ক্যান্সার। এমপিএইচ করার সময় আজিজ ভাই আমাকে বলেছিলেন তখন থেকে ১৬ বছর পরে অর্থাৎ আজকের বিশ্বে, প্রতিটা বাংলাদেশী পরিবারের একজন করে ক্যান্সার রোগী থাকবে। উনার কথা শুনে সেই সময় ভয় লাগলেও সেই ভয় এখন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিটা পরিবারে একজন ক্যান্সার রোগী আছেন।

উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের এসব মরণব্যাধি প্রতিরোধে নিজের সারাজীবনের সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমি একজন বাংলাদেশী হিসেবে কানাডায় এসেছিলাম এবং সবসময় নিজেকে বাংলাদেশী হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসি। স্থায়ী বাসিন্দার স্ট্যাটাস থাকা সত্ত্বেও নিজের কাছে আমি একজন বাংলাদেশী। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় বড় ধরনের অসুস্থতায় পড়লে হয়ত এই কানাডার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াব না।

টাকা-পয়সার ব্যাপারে সারাজীবন উদাসীন থাকা আমার পক্ষে নিজের খরচে কোনো বড় রোগের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অজস্র মানুষ যে তাদের শেষ সম্বল আঁকড়ে ধরে জীবন কাটিয়ে দেয় তা অনেক ক্ষেত্রেই শেষ জীবনে চিকিৎসা সংক্রান্ত এই অনিশ্চয়তার জন্য। তাদের যে টাকা সঞ্চিত থাকে ওই পরিমাণ টাকা ইউরোপ, আমেরিকানদের কাছে থাকলে তারা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। আমার সেজো চাচা খুবই সচ্ছল। সৎ উপায়েই তার টাকা-পয়সা যথেষ্ট। চাচির চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো অনিশ্চয়তা নেই। মনে পড়ে ছোটকালে একবার আব্বার কোমরে সার্জারির জন্য আমাদের যশোর থেকে এসে কিছুদিন ঢাকায় থাকা লাগল।

আমি ও আম্মার ছোট ভাই তপন মামা আমার সেজো চাচার বাসায় থাকতাম ড্রইংরুমে মেঝেতে বিছানা পেতে। ওই সময় চাচি হাসপাতালে আব্বার খাবার জন্য দেশী মুরগি দিয়ে পেঁপের তরকারি রেঁধে দিতেন। আমরা সেটা হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। কিছুদিন পর আম্মারও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় একটি অপারেশনের জন্য। চাচির বাসা থেকে আব্বা বা আম্মার জন্য হাসপাতালে খাবার-দাবার নিয়ে যেতাম আমি আর ছোট মামা। সেই স্মৃতি প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি। আমার এই চাচি গ্রামের আত্মীয়স্বজনদের অনেক আদর-যতœ করতেন। চাচাও গ্রামের মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত একরোখা।

এক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার কোনো সুযোগ তিনি রেখেছেন বলে মনে করি না। চাচি সেই সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স। চাইলে নিজে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু সংসারের উন্নতির লক্ষ্যে তা করেননি। তার রোগমুক্তি কামনা করি। তিনি কেবল আমার চাচিই নন, আমাদের বাংলাদেশের সাদাসিধে মধ্যবিত্ত পরিবারের হাল ধরে রাখা মায়েদের এক আদর্শ চিত্রণ। 
তিন শেলী থেকে এবার একটু স্যার বিষয়ক আলোচনায় ঘুরে তাকানো যাক। ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন এবং ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বারবার তাঁর নানা বক্তৃতায় পরিষ্কার করে বলেছেন সরকারি কর্মচারীদের জনগণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য কি সে বিষয়ে। তিনি তাদের সতর্ক করে বলেছেন বাংলার জনগণই বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার মালিক এবং সরকারি কর্মচারীদের কাজ তাদের সেবা করা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন কিভাবে হলো? বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের বলা হয় সরকারি কর্মচারী; সরকারি কর্মকর্তা নয়। কিন্তু চতুর সরকারি কর্মচারীরা তাদের ওপর সরকারসহ রাজনৈতিক দলের নির্ভরশীলতার সুযোগ নিয়ে প্রায় চার যুগের অধ্যবসায়ে সরকারি কর্মচারী পদবিকে কৌশলে, কাগজে, পরিপত্রে সরকারি ‘কর্মকর্তা’ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় তাদের যাদের সেবা করার কথা তাদের মুখ থেকেই ‘স্যার’ শোনার বাসনা জাগে। কর্মকর্তা শব্দটার মধ্যে দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ ও অপব্যবহার করার অভিপ্রায় লুকিয়ে আছে।

ঘরের মধ্যে যেমন পুরুষ মানুষ কৌশলে নিজেকে ‘কর্তা’ ব্যক্তি প্রচার করে অধিক সুযোগ নিয়ে থাকে, ঠিক একইভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে ‘কর্তা’ সেজে ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রজাতন্ত্রের সচিব থেকে শুরু করে পিওন সবাই সরকারি কর্মচারী। এই সরকারি কর্মচারীরা অফিসে তাদের ডেকোরাম বজায় রাখবেন। অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে তার অধীনস্থ কর্মচারী স্যার বলে সম্বোধন করবেন, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু জনগণ, পরোক্ষভাবে যারা সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগকর্তা তাদের কাছ থেকে ‘স্যার’ শোনার অভিপ্রায় এসব কর্মচারীকে ত্যাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণ ও সরকারি কর্মচারী একে অপরকে জনাব, জনাবা, মহোদয়, মহোদয়া ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতে পারেন। স্যার এবং ভাই দুটোই এখানে পরিত্যাজ্য। একটি সফল ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রযন্ত্র সঠিকভাবে পরিচালিত হলেই কেবল দেশের উন্নতি সম্ভব। তাই ‘স্যার’ বিতর্ক বিষয়টিকে হাল্কাভাবে দেখলে চলবে না। জনগণ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা উভয়েই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান বজায় রাখার বিষয়টা নিশ্চিত করবে এটাই সবার প্রত্যাশা। 
২৬ মার্চ ২০২৩ পালিত হলো আমাদের ৫২তম স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে যে বিষয়টি ইদানীং আমাকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তা হচ্ছে কিছু মানুষ, মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অভিলাষকে ভিত্তি করে স্বাধীনতার অবদানকে খর্ব করে দেখানো। তারা নানাভাবে বলার চেষ্টা করবে ‘আমরা কি এই স্বাধীনতাই চেয়েছিলাম’ কিংবা ‘স্বাধীনতার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে’ অথবা ‘দেশ ভাগ হয়ে কী লাভ হলো, পাকিস্তান আমলে এর চাইতে ভালো ছিলাম।’ এই ন্যারেটিভটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি নেরেটিভ, যা স্বাধীনতার পর থেকেই জারি আছে।

কিন্তু বেশি করে প্রচার করা শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আওয়ামী লীগ ২০০৮-এ ক্ষমতায় আসার পর থেকে। মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঢুকিয়ে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে ছোট করে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবোধকে ছোট করে দেখানোই এদের উদ্দেশ্য। তাদের দেখলে মনে হয় গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করা, মেট্রোরেল চালুকরণ ইত্যাদি কোনো অর্জনই নয়। মনে হয় এখন সময় এসেছে এই ধরনের ধ্যান-ধারণার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করার।

স্বাধীনতা দিবসের রাতটি নিয়েও আমাদের আরও বেশি বেশি কথা বলা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু সেই রাতের প্রস্তুতি নিয়েছেন বহু আগে থেকে এবং স্বাধীনতার ঘোষণাটিও তিনি দেন পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী। তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রবল চাপ অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ হাজার সেনা সদস্যের ঢাকা আক্রমণের সময় পালিয়ে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনি যদি পালিয়ে যান তবে পাকিস্তান একে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাস বলে বহির্বিশ্বে প্রচার করবে, যা তিনি হতে দিতে পারেন না। ওই সময়ের কথা উল্লেখ করে সাহিত্যিক মাসুদুজ্জামান লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু এতটাই দূরদর্শী ও কুশলী ছিলেন যে, একদিকে জনগণকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুব্ধ করছিলেন, অন্যদিকে আলোচনার টেবিলেও পরোক্ষভাবে অনেকটাই স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে গেছেন।

ওই দাবিগুলোকে শুধু স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল না, সেই দাবিগুলো ছিল প্রায় স্বাধীনতা অর্জনের মতো দাবি। কিন্তু পাকিস্তানিরা সেটা মেনে নিতে পারেনি। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় তাই শুরু হয় তাদের হত্যাযজ্ঞÑ অপারেশন সার্চলাইট। এরপরই রাত ১টা ৩০ মিনিটে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু এক বেতার বার্তার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তৎকালীন পাকিস্তানি মেজর এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে এর বিস্তৃত বিবরণ আছে। তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরে ‘প্রথম গুলি ছোড়ার পরপরই পাকিস্তান রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির কাছাকাছি শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ মৃদু শোনা গেল।

খুব সম্ভব আগেই বাণীবদ্ধ বার্তায় শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।’ কিন্তু পূর্বে কিভাবে তাঁর ঘোষণাটি বাণীবদ্ধ করা হয়েছিল সেটাও পরে জেনেছি আমরাÑ ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. নূরুল্লাকে অনুরোধ করেছিলেন একটি ওয়্যারলেস তৈরি করে দিতে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যন্ত্রটি দিয়ে ‘আমি আমার শেষ ভাষণটি দিতে চাই।’ সেটাই ছিল আসলে আমাদের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা। সেই ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে।

আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপোস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন।

সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দেন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা। - শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।’ এই বক্তব্যের সপক্ষে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন কূটনৈতিক দলিল উত্থাপন করতে পারি যেখানে ২৬ মার্চ দুপুর ৩টা ৫৫ মিনিটে তারা বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পাঠানো তারবার্তায় লিখেছিল পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে যখন শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়।

তারা এও উল্লেখ করে ভারত জানিয়েছে তারা এই গৃহযুদ্ধে নিজেদের জড়াবে না যদি না বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই ঝড় সীমানা অতিক্রম করে তাদের দেশে প্রবেশ করে। মার্কিনীরা এও উল্লেখ করে যুদ্ধে যারাই জিতুক না কেন তারা মার্কিনীদের দোষারোপ করতে ছাড়বে না। 
সারাবিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন বেসামাল। এই পরিস্থিতির আশু উন্নতি হবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। ন্যাটোর নানা সদস্য রাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে। চীনও এখন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকার পর সবচেয়ে শক্তিশালী রাশিয়া ও চীনের একজোট হওয়া একটি বড় ঘটনা।

অন্যদিকে ভারত প্রকাশ্যে না হলেও পরোক্ষভাবে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে। এই তিন দেশ মিলে জনসংখ্যা প্রায় ৩০০ কোটি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে আছে ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানিসহ অনেকে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে তাদের চাহিদামতো ১ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা দখল করে নিয়েছে। সব মিলিয়ে শান্তি বহু দূরের বিষয় মনে হচ্ছে। এই অশান্ত পরিস্থিতিতে সরকারকে অমিতব্যয়িতা ও দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান নেয়া উচিত। ব্যক্তিখাতে অপচয় ও বিলাসিতাকে সহজভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কিছু মানুষের এমন জীবনযাপন লাখো মানুষের দুবেলা ভাত-ডালের অধিকারকে কেড়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। 

টরোন্টো
২৭ মার্চ ২০২৩

×