ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার বিপাকে শিক্ষা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২৭ মার্চ ২০২৩

করোনার বিপাকে শিক্ষা

২০২০ সালের করোনা মহামারি আজো তার সামগ্রিক দাপট নিয়ে ভুক্তভোগীদের নাজেহাল

শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আমরা যে খুব পেছনে পড়ে আছি তা কিন্তু একেবারেই নয়। শুধু করোনা দুর্ভোগ সারাবিশ্বে যে মাত্রায় বিপন্নতার জাল বিস্তার করেছে সেখানে আমাদের মুক্ত থাকার কথাও নয়। শুধু শিক্ষা কেন? গত বছর থেকেই বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা তার অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে। তেমন দুর্বিপাকও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বর্তানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সামনের সমস্যাসঙ্কুল পথযাত্রাকে সংশ্লিষ্টদের প্রাসঙ্গিক কর্মযোগে উত্তরণ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়

২০২০ সালের করোনা মহামারি আজো তার সামগ্রিক দাপট নিয়ে ভুক্তভোগীদের নাজেহাল করে যাচ্ছে। বৈশ্বিকভাবে সম্প্রসারিত এমন অতিমারির কবল থেকে বাংলাদেশও কোনোভাবেই সুরক্ষিত থাকেনি। নতুন এক ভয়ঙ্কর রোগ যেভাবে দুনিয়াজুড়ে দুর্ভোগ ছড়িয়ে দেয় তাও একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের সূচনালগ্নের এক মারাত্মক ছোবল। চরম ছোঁয়াচে এই রোগটি শুধু ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতা নয় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরিতেও লাগাতার নেতিবাচক ভূমিকা রেখে গেছে।

বৃহত্তর এশিয়ায় চীনই প্রথম এই কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ কাল অতিক্রম করে, যার দৃশ্য সবাইকে হতভম্ব করে দেয়। সে থেকে তার নেতিবাচক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কত মারাত্মক আকারে বিস্তৃত হবে তাও ছিল ধারণার বাইরে। বাংলাদেশ এই দুঃসহ সংক্রমণের শিকার হয় ২০২০ সালের মার্চের সূচনালগ্নে। আমাদের সবারই স্মরণে আছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বছরটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণ।

কত উৎসব, আয়োজন আর আড়ম্বরে সাজানো হয়েছিল ২০২০ সালের ১৭ মার্চকে। তখন করোনা বসিয়ে দিল এক অনাকাক্সিক্ষত ব্যবচ্ছেদ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতির মেরুদ- শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবার আগে অবরুদ্ধতার জালে পড়তে হয়। ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ  করে দেয়। সে সময় ভাবাও কঠিন ছিল এই অনাবশ্যক জালে কতদিন আটকা পড়বে দেশের অগণিত শিক্ষার্থী। যেন এক অযাচিত দুর্যোগ আর অসহনীয় ক্রান্তিকাল।

ক্রমান্বয়ে অন্য অনেক কিছুর ওপর যে স্থবিরতা চেপে বসে সেখান থেকে বের হতে বহু সময় পার হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি দুরবস্থার শিকার জাতির উদীয়মান ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীরা। লাগাতার ২ বছর তারা সশরীরে কোনো শ্রেণিকার্যক্রম কিংবা পরীক্ষায় বসতে পারেনি। ফলে শুরু করা হয় আরও এক নতুন পাঠকর্মসূচি যার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো পরিচয়ই ছিল না। শুধু কি তাই? সূচনা করা প্রযুক্তির শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে সিংহভাগ ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণেও ব্যর্থ হয়।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পূর্ব ধারণা ব্যতিরেকে নতুন, আধুনিক ও চমকপ্রদ এই পাঠক্রম অনভিজ্ঞতার জালেও আটকা পড়ে। প্রযুক্তির বিশ্বে সরাসরি অভিগমনে ক্ষুদে প্রজন্ম শুধু যে অপারগ ছিল তা কিন্তু নয়। বরং ইন্টারনেটের সম্প্রসারিত ব্যবহারেও ছিল মাত্রাতিরিক্ত অপ্রতুলতা। সব মিলিয়ে ক্ষুদে ও উদীয়মান প্রজন্ম যে অব্যবস্থাপনার শিকার হয় তার দাম গুনতে হচ্ছে অদ্যাবধি। ভবিষ্যতেও যে কত খেসারত দিতে হবে সে জবাব তো সময়ের কাছে।

সম্প্রতি এক সরেজমিন গবেষণায় উঠে আসে, ২০২০-২০২১ সালের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ থাকার কারণে শিশু শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন হয়েছে তার হিসাব কখনো মিলবে কি? বলা হচ্ছে ২০২০ সালে যারা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয় তারা পর পর ২ বছর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকার কারণে শুধু লেখাপড়ার মানই কমেনি ব্যক্তিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরাও শিক্ষণ পদ্ধতি থেকে দূরে চলে যায়। এই ফারাক কখনো পূরণ হবে কিনা তাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই তো গেল প্রাতিষ্ঠানিক আর প্রযুক্তির বিশ্বের নানা মাত্রিক তারতম্যের বিসদৃশ অবস্থা।

প্রত্যন্ত অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা এমন পাঠক্রমের সঙ্গে বিযুক্তই ছিল তেমন ধারণা পরিষ্কার হয় প্রতিবেদনে। প্রথমত কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী যারা নগরে, বন্দরে, শহরে বাস করে তারা যদিও বা নতুন এই পাঠক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের বেলায়ও অন্য অনেক বিপরীত প্রতিক্রিয়া উঠে আসছে। যেমন, যে ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ফোন এতদিন শিশুদের কাছ থেকে দূরে সরে রাখা হয়েছিল করোনার কারণে সেটাই তাদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন পিতামাতা ও অভিভাবকরা।

ফলে প্রযুক্তিতে আসক্তি বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। দৃষ্টিশক্তির ওপর ডিজিটাল মনিটরের আলোর নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেহাল দশা। স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়েও চিন্তিত হওয়ার বিষয় অবশ্যই। তবে প্রতিবেদনে আরও আশঙ্কার বিষয় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা-ইংরেজি শব্দ ভুলে যাওয়ার উপক্রম। এমনকি গাণিতিক সংখ্যাও তারা চিনতে পারছে না।

পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা পড়েছে নানামুখী সমস্যায়। তাদের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা আর তৃতীয় ভাষা ইংরেজি। দুটো ভাষাই তারা ভুলে যেতে বসেছে। শব্দ, অক্ষর, বাক্য এমনকি বানানটা পর্যন্ত নাকি তাদের ধারণার বাইরে। শিক্ষা কার্যক্রমে ক্ষুদে প্রজন্মের থমকে যাওয়ার বেহাল দশা। কারণ অক্ষর ও শব্দ চেনার মূল ভিত্তিই এখন নড়বড়ে অবস্থায়। বাকিটা কিভাবে আয়ত্তে আসবে ধারণা করাও মুশকিল। সঙ্গত কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে, শিক্ষার শুরুটা যদি এমন হ-য-ব-র-ল হয় তাহলে সামগ্রিক পাঠক্রম কোন্্ পর্যায়ে ঠেকবে? এসব নিয়ে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কিত ও হতচকিত।

শিরদাঁড়া খাড়া করার মূল কার্যক্রম শিক্ষার মতো অতি দরকারি উন্নয়ন সূচক। শুধু কি উন্নয়ন? নাগরিকের মূল চাহিদার প্রয়োজনীয় খাত তো বটেই। এ তো গেল করোনার মহাদুর্বিপাকে শিক্ষা কার্যক্রমে শিশু শিক্ষার্থীর দুর্দশা। অসংখ্য শিক্ষার্থী আরও এক অনভিজ্ঞতার জালে আটকে যাচ্ছে নতুন তৈরি হওয়া আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়। এক সময় পরীক্ষাই ছিল শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। সেখানে নতুন করে সংযুক্ত হয়েছিল সৃজনশীল পাঠক্রম।

এতদিন ধরে চলে আসা এমনসব শ্রেণিপাঠের ওপর নতুন ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন, আধুনিকতা ও সময়ের চাহিদা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার আগে উল্লেখ করতে হয় নতুন কোনো কার্যক্রম শুরু করতে গেলে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অতি আবশ্যক হয়ে যায়। নতুন ধারণা ও পাঠক্রমকে সময়োপযোগী করতে প্রথমত শিক্ষকদেরই প্রশিক্ষণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। সেটা শুরু করা হলেও সার্বজনীন হয়েছে কিনা তেমন প্রশ্ন ইতোমধ্যে উঠে আসছে।

যেমনটা হয়েছিল প্রযুক্তির বিশ্বে পাঠদান নিয়ে। যা আজ অবধি প্রশ্নবিদ্ধ। যার প্রতিফলের এখন হিসাব মেলানো শুরু হয়ে গেছে। দেশে কতসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষক সংখ্যাই বা কত তার হিসাব মেলানোর চাইতেও বেশি জরুরি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ যেন সার্বজনীন করা হয়।

করোনা তার লাগাতার সংক্রমণে শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ইতোমধ্যে সংকটের আবর্তে ফেলতে পিছপা হয়নি। নতুন আর কোনো বিপন্নতা জাতির মেরুদ-কে সোজা রাখতে দেবে কিনা সেটাও বোধহয় ভাবার সময় এখন। সরকারের শত সদিচ্ছার মধ্যেও পরবর্তী কার্যক্রমে হরেক অব্যবস্থাপনা মাথা চাড়া দেওয়া নতুন কিছু নয়। বরং সেই প্রবাদবাক্য নতুন বোতলে পুরাতন মদ ঢালার অবস্থা। শুধু শিক্ষা নয় অগণিত উদীয়মান প্রজন্মের মানোন্নয়ন ছাড়াও তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার নতুন কার্যক্রমকেও সর্বাধিক সার্বজনীন করতে যা যা দরকার সবটাই করা যেন পরিস্থিতির ন্যায্যতা।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষকরা হলেন জাতি গড়ার মূল স্থপতি। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যে তাদের হাত দিয়েই তৈরি হয়েছেন। যারা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পথিকৃৎ হিসেবে নিজেদের প্রমাণও করেছেন। মাসটা মহিমান্বিত মার্চ মাস। যা নানা কারণে বাংলা ও বাঙালির কাছে অবিস্মরণীয় মাইলফলক। আবার আগের মাস ফেব্রুয়ারির দামও কোনো কিছুর বিনিময়ে হয় না। সবই বাংলা ও বাঙালির সুযোগ্য সন্তানদের অভাবনীয় কৃতিত্ব।

এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এখনো আমাদের এই সমৃদ্ধ দেশে বিশ্বমানের শিক্ষকম-লী রয়েছেন। তাদের সফলতা দুনিয়াজোড়া। স্বাধীন দেশের অকুতোভয় ও সংগ্রামী শিক্ষকরা পথিকৃৎ হয়ে আজও আমাদের পথ নির্দেশনা দিতে বিন্দুমাত্র ভাবেনও না। আর এই মুহূর্তে যারা শিক্ষক হিসেবে তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালনে সর্বস্ব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত তাদেরকেও আমলে নেওয়া বিশেষ জরুরি। জাতি গড়ার স্থপতিরাই পারে জাতিকে সঠিক পথে চালিত করে অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দিতে।

আধুনিকতার নির্মাল্যে সংযোজন-বিয়োজন যেন সময়েরই অপরিহার্য দাবি। যা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের গড়ে তুলতে হয়। আমাদের লড়াই বিপ্লব করা সময়টাই ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, অবিচারে পিষ্ট এক দুঃসহ ক্রান্তিকাল। সেখান থেকে আমরা সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মাতৃভাষার সম্মান অক্ষু রাখতে পেরেছি। অস্তিত্ব রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জনকে আয়ত্তে আনতে হরেক প্রতিকূলতাও পার করেছি।

আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের মুক্ত নাগরিক। নিজেদের ভালো-মন্দের বিচার বিবেচনায় এগিয়ে যেতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন যেন সংশ্লিষ্টদের সচেতন দায়বদ্ধতা। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আমরা যে খুব পেছনে পড়ে আছি তা কিন্তু একেবারেই নয়। 
শুধু করোনা দুর্ভোগ সারাবিশ্বে যে মাত্রায় বিপন্নতার জাল বিস্তার করেছে সেখানে আমাদের মুক্ত থাকার কথাও নয়। শুধু শিক্ষা কেন? গত বছর থেকেই বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা তার অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে। তেমন দুর্বিপাকও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বর্তানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সামনের সমস্যাসঙ্কুল পথযাত্রাকে সংশ্লিষ্টদের প্রাসঙ্গিক কর্মযোগে উত্তরণ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।

তেমন  যাত্রাপথ সহজ ও স্বাভাবিক করতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকম-লীই যথেষ্ট যারা শিশু শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সমৃদ্ধ বলয়ে নিজেদের অভাবনীয় অবদানে জাতিকে সম্ভাব্য পথ নির্দেশনা চিহ্নিত করতে সক্ষম। নিত্যনতুন কিছু সামাজিক জরিপ আমাদের ভাবায়। তখন পথ হারানোর শঙ্কায় বিব্রতবোধ করি। তবে সমাধানযোগ্য হরেক ব্যবস্থাপনায় সংকট কাটতেও খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। বহু বিতর্কে জড়ানো পদ্মা সেতু এখন বাস্তব কার্যক্রমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

মেট্রোরেলও তার অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় সাধারণ জনগণের নাগালে পৌঁছে গেছে। বঙ্গবন্ধু টানেলও আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায়। সেখানে আমাদের চেতনাগত বিকাশও সার্বিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। আর শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে তার যথাযথ স্থানে অতি আবশ্যিকভাবে পৌঁছাতে হবেই। 
লেখক : সাংবাদিক

×