ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

শিক্ষাক্রমে প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষা

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:২৯, ১ মার্চ ২০২৩

শিক্ষাক্রমে প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষা

বর্তমানে মোটাদাগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিন ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে

বর্তমানে মোটাদাগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিন ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রধান শিক্ষা ধারা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা বাংলা। এর পাশে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষায় একটি ধারায় বাংলা, গণিত, ইংরেজি, ইতহাস, ভূগোল ইত্যাদির পাশে কুরআন, হাদিস শিক্ষা প্রদান করা হয়, যারা সরকারি শিক্ষাক্রম ব্যবহার করে। অপর বেসরকারি মাদ্রাসাগুলোতে শুধু কুরআন-হাদিস পড়ানো হয়। অর্থাৎ আরবি মাধ্যমে শিক্ষা দান করা হয়।

এসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বাংলা তেমন শেখে না। তৃতীয় ধারাটি ৮০’র দশকে একদল আমলা-প্রশাসকের উদ্যোগে নিজেদের সন্তানদের পাশ্চাত্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণে পারদর্শী করে তোলার লক্ষ্যে প্রথম দেশে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে এসব স্কুলের প্রতি সাধারণ পিতামাতা, অভিভাবকবৃন্দ তেমন আগ্রহী ছিল না। পরবর্তীকালে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ‘কোচিং’ এবং ‘প্রশ্ন ফাঁস’, আরও পরে ‘নকল’ প্রবণতার বদনামের ফলে ক্রমশ বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো তাদের এক সময়ের অর্জিত সুনাম হারাতে থাকে। বর্তমানকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, বিভাগীয় অন্যান্য পরীক্ষায় ‘নকল’ করার খবরও প্রকাশিত হয়েছে, যা অকল্পনীয় এবং চরম অসম্মানজনক।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাবা, মা, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে দেখা যায়, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস এইট পর্যন্ত কোনো কোচিং দরকার হয় না। নবম, দশম শ্রেণিতে ওঠার পর ‘ও’ লেভেল এবং এরপর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ‘এ’ লেভেলের পড়াশোনায় শিক্ষার্থীরা দলগত ‘কোচিং’ গ্রহণ করে।

এই বিষয়ভিত্তিক কোচিং প্রায় শ্রেণি-ক্লাসের মতই সংঘটিত হয়। যেখানে শিক্ষক কর্তৃক ‘ধর্ষণ’ বা অন্যান্য অপরাধ হয়নি, অন্তত আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। বাংলা মাধ্যমের প্রতি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অনাগ্রহ দ্রুত ৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বৃদ্ধি পায়। এমনকি সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষকদেরও নিজেদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করাতে দেখা যায়।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সন্তানরা ইংরেজিতে দক্ষ হলে ভবিষ্যতে তারা ভালো চাকরি পাবে- এমন চিন্তা থেকে মধ্যবিত্ত পিতামাতাও সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছে। তারা বলছে,  ক্লাস এইট পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে যে কোচিংয়ের পেছনে অর্থ ব্যয় হয়, সে টাকা এখানে লাগে না। কথাটা অসত্য নয়। তবে এবার আমাদের দেখতে হবে আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা শেখানোর ক্লাস আছে ঠিকই, কিন্তু তার চর্চা ও মান কেমন?
প্রথমেই আমরা দেখতে পাই, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ ছাড়া ইংরেজিতে কথোপকথন করে না, বাংলাতেই কথা বলে।

কিন্তু তারা সাধারণত বাংলা কোনো গল্প-কবিতার বই, কমিক বই, বাংলা সংবাদপত্র পড়ে না। সুন্দর গল্পের বইগুলো তারা ছুঁয়েও দেখে না। তাদের মা-বাবা কি সন্তানদের কখনো একুশের বইমেলায় নিয়ে আসে? ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা কি নিজেরা স্বেচ্ছায় বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে বইমেলায় এসেছে? ‘লিট-ফেস্ট’-এ কেউ কেউ গেলেও বেশির ভাগ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা একুশে বইমেলায় এসেছে, এমনটি দেখা যায় না। এর অর্থ দাঁড়ায়, সমাজের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মা-বাবা- যারা ভালো বাংলা জানে, তাদের সন্তানরা বাংলাবিমুখ একটি বড় শ্রেণি হয়ে উঠেছে।

যারা বাংলা পড়ে না, সেজন্য বাংলার কাব্য-সাহিত্যের স্বাদ পায়নি। অধিকাংশই রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত শোনে না বা শেখে না। হালে কোনো কোনো ব্যান্ড সংগীত দলকে বাংলার লোকসংগীত, বাউল গান, লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিম, হাছন রাজার গান গাইতে দেখা যাচ্ছে। ভাষার গান, দেশের গানও কোনো কোনো পপ্্ গায়কদের গাইতে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে এই বড় একটি নতুন তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষা পড়তে, লিখতে পারে না! উচ্চমানের সাহিত্যের প্রমিত বাংলা, বাংলাভাষার বহু সুন্দর সুন্দর শব্দ, বাক্য, অত্যন্ত উঁচু মানের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রহস্য গল্প, হাস্যরসের গল্প যেমন- গোপাল ভাঁড়, এসব কিছুরই স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত থেকে গেল!

এমনও না যে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শেক্সপিয়ার, এলিয়ট, জেন অস্টেন, টেনিসন, ডি এইচ লরেন্স, জ্যাক লন্ডন বা টলস্টয়, শেখভ, গোর্কী পড়েছে। তারা কি কখনো দেশের নাটক দেখেছে? বাংলা চলচ্চিত্র দেখেছে? মনে হয় না। বর্তমান যুগের ইংরেজি বা বিদেশী কাব্য-সাহিত্য কি তারা পড়ে? সম্ভবত নয়! কেউ কেউ বিদেশী ইংরেজি চলচ্চিত্র দেখে থাকে, ইংরেজি পপ্্-জ্যাজ, ব্যান্ড  সংগীত শুনে থাকে, কিন্তু বাংলা গান শোনে না, শেখে না। মাতৃভাষা বাংলার প্রমিত রূপ কথ্য বাংলায় তারা দেখতে পাচ্ছে না। কথ্য শুদ্ধ বাংলায় হয়ত শুধু কথা বলছে।

কিন্তু বাংলা বই পড়ছে না। যেহেতু পড়ছে না, সেহেতু বাংলা বানান, বাক্যগঠন শুদ্ধ, প্রমিত বাংলায় হবে না, তা বলা বাহুল্য। সমাজের বেশ বড় একটি  অংশ বাংলার প্রমিত রূপ  শিখছে না। 
উল্লেখ্য, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতার ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয়ের মান ভালো, কিন্তু মাতৃভাষার দক্ষতায় তারা দুর্বল। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতা দক্ষতা রয়েছে, যেহেতু তারা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল পাঠ করে। কিন্তু তাদের প্রয়োজন দুর্বল সাক্ষরতার দক্ষতার গুণগত মানোন্নয়ন।

আমরা সাধারণ শিক্ষা গ্রহণরত প্রধানত বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। যেহেতু তারাই শিক্ষা ব্যবস্থার সিংহভাগ শিক্ষার্থী। আগে আলোচিত দুই ধারাÑ ইংরেজি ও মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণরতদের মাতৃভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করার ব্যবস্থা ও উপযুক্ত পদক্ষেপ অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে। নতুবা, সর্বজনীন  শিক্ষাকে মানসম্মত করার প্রক্রিয়ায় উক্ত দুই ধারা বাদ পড়ে যাবে। 
এখন আসা যাক বাংলা ভাষার প্রমিত ও আঞ্চলিক রূপের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনায়। বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ আমরা বইয়ের ভাষায় দেখতে পাই। এ ভাষার ওপর কোনোরকম আঞ্চলিক ভাষাÑ ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট বা চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষার কোনো প্রভাব নেই। বর্তমনে আমরা প্রধানত টিভি নাটকে চরিত্রাভিনেতাদের মুখে আঞ্চলিক ভাষার প্রকট ব্যবহার দেখছি। কথা হচ্ছে, নাটকে চরিত্রাভিনেতাদের স্থানীয় ভাষায় সংলাপ বলাটা বর্তমানে অতিরিক্ত বেশি হচ্ছে। যা দেখে মনে হচ্ছে, দর্শক যারা এই নাটকগুলো শুনছে, দেখছে, তারা স্থানীয় ভাষাকে বাংলা ভাষার প্রধান ও স্থায়ী রূপ ভাবছে এবং এ ভাষাকেই অনুকরণ করছে কিনা! 
তবে মঞ্চ নাটক এবং অনুবাদ নাটকে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার হচ্ছে, যা শ্রুতিমধুর এবং নাটককে মানসম্পন্ন করে। কদিন আগে বিটিভিতে কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের অনুবাদ ‘ছদ্মবেশী’ নাটকটি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তার বাছাই করা গল্প সংকলন আগামী থেকে প্রকাশ করেছি একটি উদ্দেশ্যে- সেখানে অনেক গল্প, নাটক অথবা চলচ্চিত্র হওয়ার উপযোগী। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারবেন। 
দ্বিতীয়ত, ফেসবুক নামক প্ল্যাটফর্মে দেখতে পাচ্ছি, অধিকাংশ ব্যক্তি যারা মন্তব্য করে, তারা বাংলা ভাষা চরম অশুদ্ধ শব্দে, বাক্যে লিখছে। অর্থাৎ, বাংলা মাধ্যমে পড়া ঐ প্রতিক্রিয়াদানকারীরা বাংলা ভাষার শুদ্ধ শব্দ, এর বানান, ব্যবহার এবং শুদ্ধ বাক্য লিখতে শেখেনি।
আমাদের স্কুলে এবং ঐ যুগের সব স্কুলে একটি নিয়ম বলবৎ ছিল যে, স্কুলে সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবে, কেউ আঞ্চলিক বা ঘরের কথ্য ভাষায় কথা বলতে পারবে না। এর ফলে আমাদের সময়কার শিক্ষিতদের শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার অভ্যাস হয়েছে, যা এখনো বজায় আছে। এখনকার শিক্ষার্থীরা ঘরে, পরিবারে যে ধরনের ভাষায় কথা বলে, সে ভাষায় তারা স্কুলেও কথা বলে। সে ভাষা আঞ্চলিক ভাষা হলে, সেটি তাকে স্কুলে শুদ্ধ করে দেওয়ার মতো শিক্ষক আছেন কিনা, তারা শুদ্ধ কথ্য বাংলা শেখান কিনা, জানি না।

অথবা, শিক্ষকরা নিজেরাই সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। হয়ত তাদের শিক্ষকরাও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শেখাননি এবং নির্দেশনাও দেননি। এভাবে আমাদের প্রধানত মফস্বলের সরকারি স্কুলে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার চর্চা কমে এর স্থান নিয়েছে স্থানীয় আঞ্চলিক কথ্য ভাষা।  এ অবস্থার পরিবর্তন করা কঠিন কোনো কাজ নয়। আবার পুরনো নির্দেশ দিতে হবে, স্কুলে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে হবে। এটি নিয়ম করে মেনে চললে ধীরে ধীরে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে শিখবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক- উভয়েই।

তবে স্কুলে আগের মতো শ্রুতিলিখন, জোরে জোরে রিডিং পড়া এবং প্রতিদিন এক পাতা হাতের লেখা লিখতে লিখতে শিশু-কিশোররা বাংলা শুদ্ধ বানান, শব্দ ও বাক্য পড়তে এবং লিখতে শিখবে। আদর্শলিপির মতো কঠিন শব্দসহ প্রবাদবাক্যগুলো হাতের লেখা ও বানান শেখায় ব্যবহার করলেও দ্রুত সুফল আসবেÑ এতে সন্দেহ নেই। শুদ্ধ বাংলা শেখার জন্য হাসিখুশি, রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ ১ ও ২ পড়লে এবং আদর্শলিপির হাতের লেখা লিখলে বানান ভুল থাকবে না।

শুদ্ধ বাংলা বাক্য পড়তে ও লিখতে পারবে শিশু-কিশোররা। খুব বেশি পরীক্ষা-নীরিক্ষা না করে এই বই কটি নতুন প্রজন্মকে ভালো বাংলা শিখিয়ে ধরিয়ে দিতে পারে। স্কুল পাঠাগার থেকে ভালো গল্পের বই ছাত্র-ছাত্রীকে দিতে হবে এবং সেগুলোর ওপর কিছু মূল্যায়ন ব্যবস্থাও থাকতে পারে।
আমরা কথোপকথনে অনেক সময় অপ্রয়োজনে বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ লাগিয়ে কথা বলি। এ অভ্যাসটি অবশ্য আমরা স্কুল থেকে শিশু-কিশোরদের বিদেশী, ইংরেজি শব্দ না ব্যবহার করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার অভ্যাস করাতে পারি। এটি খেলার মাধ্যমেও হতে পারে। শুদ্ধ বাংলা ভাষা অত্যন্ত মধুর ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। এ ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য ছাত্র-যুবক প্রাণ দিয়েছে।

আমরা যদি আমাদের শুদ্ধ ভাষার চর্চা না করি, তাহলে ভাষা শহীদ এবং ভাষাকেই আমরা অসম্মান করব। যে বাঙালি সেদিন মাথা নত করেনি, ’৭১এ-ও মাথা নত করেনি, সেই বাঙালি তার মাতৃভাষাকে উচ্চস্থানে নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই- এ আশা আমাদের মেধাবী তরুণদের কাছে আমরা করতেই পারি।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×