
মানুষে মানুষে সংযুক্তির সেতু ভাষা। নিজেকে ব্যক্ত করার বাহন ভাষা
মানুষে মানুষে সংযুক্তির সেতু ভাষা। নিজেকে ব্যক্ত করার বাহন ভাষা। মানুষের এই সহজাত প্রপঞ্চ জীবজগতে অনন্য। অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার এই বৌদ্ধিক অভিব্যক্তি সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণ করেছেÑ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় ভাষাপ্রয়োগের মধ্য দিয়েই মানুষের ভাষাজ্ঞান বিকশিত হয়। এভাবেই বেড়ে ওঠে ভাষা, তিলে তিলে সমৃদ্ধ হয়।
জনপদের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, উৎপাদনব্যবস্থা, শারীরিক গড়ন, মানসিক ধাঁচ, জীবনচর্যা এমনকি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্পর্শ সমাজমননের আদল গঠনে প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রবল ভূমিকা রেখে চলে। ভাষা তারই অনিবার্য ব্যঞ্জনা। ভাষা বিকাশের পিছনে কাজ করে একটি সমাজের বহু শ্রম, বহু ত্যাগ, বহু সাধনা। সৃষ্টিলগ্ন থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ভাষার লক্ষণীয় বিবর্তনই সেই সাক্ষী বহন করে চলে।
সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ভাষাবোধ। ভাব ও ভাষার সম্পর্ক গভীর। বিবর্তনের চিহ্ন বহন করে ভাষা। ভাষা বিশ্লেষণ করেই একটি সমাজ বা গোষ্ঠীর চরিত্র, মানসগঠন ও আচরণ সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। মানবকুলের মতোই ভাষাও নানা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিশীলন ও আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে নিজে সমৃদ্ধ হয়। যে কোনো শক্তিশালী ভাষার এটাই ধর্ম। ভাষার আরও একটি সহজাত প্রবণতা হলো- যে কোনো উৎস থেকে শব্দগ্রহণ করা। বিদেশী শব্দের অস্তিত্ব সবসময় সবভাষায় ছিল, আছে ও থাকবে। মুশকিল ঘটে তখনই যখন ব্যক্তি মাতৃভাষার প্রতি তার মমত্ব হারিয়ে ফেলে।
অন্যের ভাষায় গরিমার সন্ধান পায়। আর শহর বা শহরতলির নব্য একটি এলিট প্রজন্ম জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। সেখানে প্রবলতর ভাষার আধিপত্যের বিষয়টি গৌণ। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষায় সাবলীল হতে পারলে, সোজা কথায় শুদ্ধভাবে বলতে কিংবা লিখতে পারলে তাতে দোষের কিছু থাকে না। কিন্তু ভাষায় শব্দের যথেচ্ছ ও বেহিসেবি অনুপ্রবেশ ভাষার লালিত্য, মাধুর্যকে নষ্ট করে। মনগড়া বিকৃত ভাষার ব্যবহার বিপন্নতার চিত্র মেলে ধরে। আসলে ভাষার সঙ্গে থাকে আবেগ, যাকে আঘাত করলে ভাষায় ছন্দপতন ঘটে, ভাষা নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।
ভাষার বিকাশ ঘটে মানুষের সামাজিকতায়। বলা ও শোনার মধ্য দিয়ে। কথ্য ভাষার এই চর্চাকে সংকেতের মধ্য দিয়ে লেখ্য ভাষায় রূপান্তর করা হয়। প্রায় হাজার বছর যাবৎ বাঙালি লিখিত ভাষার এই চর্চা করে আসছে। ১৮ শতকের আগে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র পরিচিতি ছিল না। প-িতদের কাছে সংস্কৃত, সাধারণের কাছে লৌকিক ভাষা গ্রাহ্য ছিল। কথ্য ভাষার গঠনশৈলী বিচিত্র। বাক্যগঠনের বিভিন্নতা, শব্দে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব ও ধর্ম-জাতি-জীবনাচরণের ছাপ উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলা ভাষার কলেবর তৈরি করেছে। ভাষা রাজনৈতিক সীমা মানে না। ভাষার ঐতিহ্য বহমানতা।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন অঞ্চল ও সময়ের নানা মিশ্রস্রোত ভাষার মূলধারায় মিশেছে। এভাবেই বাংলা ভাষার ব্যাপ্তি ও উৎকর্ষ ঘটেছে। ১৯ শতকে গৌড়ীয় ভাষায় ব্যাকরণ প্রণীত হয়। উইলিয়াম কেরির ব্যাকরণ মূলত সাধু ভাষার ব্যাকরণ। রাজা রামমোহন রায়, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার, বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের কাঠামো প্রণয়ন ও ভাষার প্রমিতকরণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরী ভাষার কথ্যরূপের আদর্শ কাঠামো দাঁড় করিয়ে বাংলাকে বিশ্বমানের ভাষায় উন্নীত করেন। ১৮ শতক থেকেই এ জনপদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে জাতি হিসেবে বাঙালি, আর তাদের মুখোচ্চারিত ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শুধু রাষ্ট্র পরিচালনায় নিছক কোনো দল বা ব্যক্তির বদল হয়নি, রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ ও দর্শনও পাল্টে যায়। মুক্তিযুদ্ধের অবলম্বন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উৎখাত করে সাম্প্রদায়িক বিষযুক্ত জাতীয়তাবাদের ধারণাকে জনমানসে কৌশলে সংক্রমিত করা হয়। রাষ্ট্রের মদদে চলতে থাকে সামাজিক বিভাজন প্রক্রিয়া। ড. কুদরাত-ই-খুদার বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য থেকে দেশ কক্ষচ্যুত হয়। সমাজকাঠামোয় বিভেদ, বৈষম্য ও কৃত্রিম বিভাজন তৈরি হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন বিশ্বজনীন শিক্ষা অধরা থেকে যায়। রাষ্ট্রের সমর্থনে বেড়ে ওঠা নব্য এলিট শ্রেণির সেবায় রাতারাতি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো গজিয়ে উঠতে শুরু করে।
নতুন করপোরেট বেনিয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় এরা তৎপর হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নব্য এই গোষ্ঠীর কাছে তাচ্ছিল্য ও অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আশ্রয় হয় মাদ্রাসা, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ভাষাশিক্ষার সুযোগ অপ্রতুল। নি¤œ-মধ্যবিত্তের জন্য অবশিষ্ট থেকে যায় মানহীন সাধারণ শিক্ষা। সমস্বত্ব একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্য সামাজিক বিভক্তির এই আয়োজন পাকিস্তানি ভাবধারা ও নব্য উপনিবেশবাদের একটি অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত। অর্থনৈতিকভাবে সম্পন্ন পরিবারের জন্য ইংরেজি। প্রান্তিক পরিবারের অবলম্বন বাংলা কিংবা আরবি। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজনের এই ধারা জাতিসত্তা বিকাশের পথে স্পষ্ট অন্তরায় সৃষ্টি করে।
বাংলাভাষা শুধু আঞ্চলিকতায় পীড়িত হয়ে পড়ছে তা নয়, ভাষাটি ইংরেজি, হিন্দি বা আরবির অনিয়ন্ত্রিত ও যথেচ্ছ অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। আসলে বাংলাভাষা ক্ষয়ের একটা পর্যায় অতিক্রম করছে। ২১ শতকের প্রজন্ম ইংরেজির প্রতি যতটা যতœশীল, বাংলার প্রতি ততটা নয়। ভুল বানান শিশুকে বিভ্রান্ত করে। সেখান থেকে জন্ম নেয় মাতৃভাষার প্রতি অনীহা আর সৃষ্টি হয় মানসিক দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব। প্রথম প্রজন্ম অথবা নিম্নবিত্তের মানুষের মাঝে এখনো বেঁচে আছে বাংলা। মাতৃভাষার সাবলীল রূপ এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে গ্রামবাংলায়।
উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের কাছে বাংলা বলতে না পারাটা গর্বের। ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। শহর বা শহরতলিতে তো বটেই, এমনকি গ্রামে-গঞ্জেও গজিয়ে উঠছে নিম্নমানের ইংলিশ মিডিয়াম কেজি বা আরবিব্র্যান্ডে ইসলামি ক্যাডেট স্কুল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, করপোরেট শিল্প, বিজ্ঞাপন, বিপণি বিতানের নামকরণ, এমনকি অফিস-আদালতে পর্যন্ত ইংরেজির একচেটিয়া দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত। বাংলা সেখানে প্রায় ব্রাত্য। শ্রেণি, পেশা, ধর্র্ম, আদর্শ নির্বিশেষে নতুন প্রজন্ম ছুটছে ইংরেজির দুর্নিবার আকর্ষণে।
দেশের সন্তানরা নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি পড়ছে না। কোরিয়া, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের ভাষাপ্রেম ও সামাজিক উন্নয়নের মডেলকে তারা আমলে নিচ্ছে না। গবেষকদের থিসিসও অভিজাত হয়ে যাচ্ছে যদি কিনা তা ইংরেজিতে লেখা হয়। অবচেতন মনে বাংলার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা বা কুলীন সাজার লালসা বাংলাকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি জাতির অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে তার ভাষার সঙ্গে। রক্তের দামে কেনা এ ভাষা বিশ্ব দরবারে প্রাপ্য সম্মান, উপযুক্ত মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে।
গর্বিত এ নাগরিক সমাজের বাংলার প্রতি এমন অবহেলা খুবই বেমানান। আসলে বিপন্ন ও বিলীন ভাষাগোষ্ঠী পরিচর্যার অভাবে ধ্বংসের কাছে পৌঁছে যায়। নিজের ভাষার প্রতি মমত্বই মানুষকে অন্যের ভাষার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। অভিভাবকের নির্লিপ্ততা বা কৌলীন্যের ভ্রান্ত ধারণা সংকটকে দীর্ঘায়িত করে। কল্পনার পরিচর্যা, ভাবনার পরিশীলন মায়ের ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল, বিশ্বের যেখানেই চিন্তাশক্তির উৎকর্ষ ঘটেছে, সেখানেই নিয়ামক হয়ে উঠেছে মাতৃভাষা।
ইতিহাস অনুসন্ধানে ধরা পড়ে- দেশভাগের আগে লাখো লাখো বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান কায়েমের আবেগে ভেসেছে। আরবি, ফারসি শব্দগুলো বাংলা শব্দগুলোকে ত্বরিত গতিতে ক্রমাগত ছিটকে ফেলছিল। সাতচল্লিশপূর্ব প্রায় দশকজুড়ে চলে এমন কা-। দলে দলে মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছে। আত্মপরিচয়ের সত্তায় বাঙালিত্বের পরিসর ছোট হতে শুরু করে। বাঙালি মননে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনও হয়ত তখনই সম্পন্ন হয়েছে। সরল ও সাধারণ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা আর স্বপ্ন এই আরোপিত আবেগের নিচে নিভৃতেই চাপা পড়েছে।
উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার শাসকের যে মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তা হয়ত তখনই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ জনপদের এই মানসিক গড়নের প্রকরণ দ্রুত পাল্টে যায়। পাকিস্তানে বাংলাভাষী ছিল যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ, উর্দুভাষী একদমই নগণ্য। জিন্নাহ সাহেব তবুও বললেন-উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহ নিজেই ভালোভাবে উর্দু জানতেন না। বলতেনও না। তবে ভালো ইংরেজি জানতেন। শাসকের কৌশল ছিল- ক্ষমতার দখলে থাকবে উর্দু ও ইংরেজি।
ভাষায় একচেটিয়া দখলদারির লক্ষ্য হলো- সামাজিক কর্তৃত্বে ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা। হিন্দু সামন্ত শ্রেণির হাত থেকে মুক্তির আশাই বাঙালি মুসলমানকে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা ক্রমেই ঘনীভূত হতে লাগল। কোনো জাতি না খেয়েও উঠে দাঁড়াতে পারে, যদি তার সংস্কৃতি আক্রান্ত না হয়। আর ভাষাই যে সংস্কৃতির প্রাণ- এ উপলব্ধি বাঙালি চেতনায় প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে।
ভাষার জন্য যে লড়াই তা নিছক কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না, ছিল পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও বিদ্বেষের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। বাংলার ছাত্রজনতা, লেখক, বুদ্ধিজীবী দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভ্রান্তি উপলব্ধি করেন ও তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই আন্দোলন পাক উপনিবেশবাদের আর্থ-সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের এক পুঞ্জীভূত বিস্ফোরণ। তবে এর মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অবিশ্বাস্যভাবে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের সম্পৃক্ততায় আন্দোলন গণচরিত্র লাভ করে।
৪৭-উত্তর দেশভাগের পর একদিকে যেমন পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের নগ্ন চিত্র ভেসে উঠেছিল, ঠিক অন্যদিকেই জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনির্বাণ দীপশিখা। যার বীজ অনেকের মতে বাঙালি মননে প্রথিত হয়েছিল বহু আগেই। ১৯৩০-৪৭ পর্যন্ত দেশভাগপূর্ব সাম্প্রদায়িকীকরণের সমকালীন স্রোত অনায়াসে উপেক্ষিত হয়। অন্যদিকে মজবুত হতে থাকে বাঙালির আবহমান বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। ইংল্যা-ে শিল্পবিপ্লব, রুশবিপ্লব বা ফরাসী বিপ্লবের মতোই আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও এগিয়ে এসেছিল বাঙালির স্বাধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে।
সূচনা হয়েছিল একটি শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের স্বপ্নে রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলার লড়াই। রক্তাক্ত ভাষাযুদ্ধের ফল ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ; যার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। ফলত ঘটে যায় একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের দুনিয়া কাঁপানো অভ্যুদয়।
বাঙালিত্ব একটি উদারবাদী চেতনা যা নব জাগরণের আলোয় স্নাত। আর্থ-সামাজিক কাঠামো বদলের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে চিন্তার কাঠামো পাল্টে যায়, তা আজ বহুভাবে চর্চিত। বিভক্ত ভাবনার স্রোত কিংবা সংঘর্ষপূর্ণ সমাজমন সমস্বত্ব জাতির জন্য কখনই প্রত্যাশিত নয়। আদর্শিক শূন্যতা থেকে দুর্নীতি, নৃশংসতা এমনকি জঙ্গিবাদের উত্থান পর্যন্ত ঘটতে পারে। শিকড় নড়বড়ে থাকায় সহজেই তা মগজে ঠাঁই পেয়ে যায়। কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক পরিচ্ছদ-সর্বত্রই ফুটে ওঠে বিজাতীয় সংস্কৃতির দাপট।
পাঠ্যপুস্তক, কারিকুলাম-সবখানেই যদি আপোস অনিবার্য হয়ে যায়, তবে মনোজগতে কর্তৃত্ব করবে ঔপনিবেশিক দাসত্ব, আদর্শিক দেউলিয়াত্ব। আর জাতি হয়ে উঠবে দৃশ্যত লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীন। এভাবেই তৈরি হতে পারে বৈরী এক সামাজিক মনস্তত্ত্ব। দেশ আজ স্বাধীন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। গোটা বিশ্বের নজরে বায়ান্নর আত্মত্যাগ। পৃথিবীর সব ভাষাগোষ্ঠীর জন্যই এ দিনটি মহিমান্বিত। আমাদের চোখের জলে, চেতনার স্রোতে, শরীরের মজ্জায় আজ ফেব্রুয়ারি। এ ভাষার প্রতি আমাদের শুধু সম্ভ্রমই নেই, দায়বদ্ধতাও আছে।
একুশের শিশিরভেজা প্রভাতফেরিতে আজও শহীদ স্মরণে কণ্ঠের দখল নেয় আবেগ। কিন্তু ভাষার জন্য সেই ব্যাকুলতা কি আমাদের অন্তরে আজও জেগে আছে- এ প্রশ্ন আমাদের নিয়ত বিদ্ধ করে। সর্বস্তরে বাংলা এখনো চালু হয়নি। প্রত্যাশা থাকবে ভাষা দিবসের মানবিক চেতনা যেন রাজনীতির চোরাগলিতে হারিয়ে না যায়। কেবলই জনস্মৃতি আর আনুষ্ঠানিকতায় যেন পর্যবসিত না হয় মহান একুশে। মাতৃভাষার যথাযোগ্য মর্যাদায় একুশ যেন বেঁচে থাকে কালের সীমান্ত পেরিয়ে।
লেখক : ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়