
.
আমাদের সামনে উপস্থিত পবিত্র শবে মিরাজ। লাইলাতুল মিরাজ বা প্রিয় নবী (স.)-এর ঐতিহাসিক ঊর্ধ্বলোক ভ্রমণ রজনী। পবিত্র রজব মাসের এ এক ঐতিহাসিক অনুভব মুহূর্ত। রজব মাসের মিরাজ রজনীর পর শাবান মাসের শবে বরাত এবং পরবর্তী রমজান মাসের শবে কদরের মধ্যে এক বড় ধরনের আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলে আকরাম (স.) রজব ও শাবান মাসের জন্য এরূপ দোয়া করতেনÑ ‘আলাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বালিগানা রামাদান।’ -(প্রভু হে! রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত নাজিল করুন আর আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন)।- (মা-সাবাতা বিস্ সুন্ন্হ)।
স্মর্তব্য, ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে মিরাজ সেই সব ঘটনার অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো বিশ্বে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সাধারণ বর্ণনা অনুযায়ী, এই ঘটনা হিজরতের আনুমানিক এক বছর আগে ২৭ রজবের রাতে সংঘটিত হয়েছিল। কুরআন পাকেও এই ঘটনার উল্লেখ হয়েছে এবং হাদিস শরীফেও। মিরাজ কি কারণে হয়েছিল এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (স.) কে ডেকে নিয়ে কি হিদায়েত দিয়েছিলেন, তা কুরআন বলে দিয়েছে। মিরাজ কিভাবে হলো আর এ সফরে কি ঘটনা ঘটেছিল, তা হাদিস শরীফে ব্যাখ্যা রয়েছে।
পবিত্র সূরা বনী ইসরাঈলে বলা হয়েছে- ‘পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ সূরা নাজমে বলা হয়েছেÑ ‘অতঃপর নিকটবর্তী হলো ও ঝুঁকে গেল। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা প্রত্যাদেশ করলেন। রাসূল (স.) এর অন্তর মিথ্যা বলেনি যা তিনি দেখেছেন। তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা তিনি দেখেছেন?’(আয়াত : ৮-১২)।
মিরাজের বিস্তারিত বিবরণ সমসাময়িককালের ২৮ জন রাবীর মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৭ জন বর্ণনাকারী স্বয়ং মিরাজের যুগে বর্তমান ছিলেন। আর ২১ জন বর্ণনাকারী এমন ছিলেন, যারা পরে রাসূলে করীম (স.) এর জবান মুবারকে মিরাজের ঘটনা শুনেছিলেন। বর্ণনাকারীদের বিভিন্ন বর্ণনা ঘটনাটির বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করে। সবগুলো মিলালে এমন একটি সফরনামার বিবরণ তৈরি হয়, যার চেয়ে অধিক হৃদয়গ্রাহী, অর্থবহ ও দৃষ্টি আকর্ষণকারী সফরনামা মানব সাহিত্যের ইতিহাসে আর একটিও পাওয়া যায় না।
হযরত মুহাম্মদ (স.) রিসালাত প্রাপ্ত হয়েছেন ১২ বছর আগে যখন তার বয়স ছিল ৫২ বছর। কারও কারও বর্ণনা মতে, কাবার হারাম শরীফে তিনি শুয়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) এসে সালাম দিয়ে তাঁকে জাগালেন। আধা ঘুম আধা জাগরণ অবস্থায় তাঁকে জমজম কূপের নিকট নিয়ে গেলেন। সিনাসাক (বক্ষ বিদারণ) করলেন। জমজমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে নিলেন। তারপর তাঁকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সহিষ্ণুতা, ঈমান ও ইয়াকীনে ভরে দিলেন। এরপর তাঁর আরোহণের জন্য জীব পেশ করা হলো। এর রং ছিল সাদা। আকারে খচ্চরের চেয়ে কিছু ছোট ছিল। বুরাক বা বিজলির গতিতে চলত। এই সাদৃশ্যের কারণে এর নাম বুরাক দেওয়া হয়েছিল।
তিনি যখন আরোহণ করতে যাচ্ছিলেন বুরাক চমকে উঠেছিল। জিবরাঈল (আ.) তখন ধমক দিয়ে বললেন, দেখ তুমি কি করছো। আজ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (স.) এর মতো কোনো ব্যক্তিত্বশালী মানুষ তোমার পিঠে অরোহণ করেনি। এরপর তিনি এর উপর আরোহণ করলেন। জিবরাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে চললেন। প্রথম মঞ্জিল ছিল মাদীনাতুল মুনাওয়ারা। এখানে অবতরণ করে তিনি নামাজ পড়লেন। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এখানে আপনি হিজরত করে আসবেন। দ্বিতীয় মঞ্জিল ছিল মুসা নবীর (আ.) পুণ্য স্মৃতিবিজড়িত সিনাই উপত্যকা। তৃতীয় মঞ্জিল ছিল বেথেলহাম। এখানে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চতুর্থ মঞ্জিল ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। এখানে অসংখ্য নবীর কবর, বিশেষ করে হযরত ইবরাহীম ও তাঁর সন্তান নবী ইসহাক (আ.) এর মাজার। এখানে বুরাকের মাধ্যমে সফরের প্রথম পর্ব শেষ হয়।
এই সফর চলাকালে এক জায়গায় কোনো আহ্বানকারী আহ্বান করে বললÑ এদিকে এসো। তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। জিবরাঈল (আ.) বললেন, সে আপনাকে ইহুদীবাদের দিকে আহ্বান করছিল। আর একদিক থেকে আওয়াজ এলো, এদিকে এসো। তিনি সেদিকেও লক্ষ্য করলেন না। জিবরাঈল (আ.) বললেন সে আপনাকে ঈসাইয়াতের দিকে আহ্বান করছিল। এর পর খুব সাজগোজ করা নারী নজরে পড়ল। সেও নিজের দিকে আহ্বান জানালো। তিনি তার দিকেও ফিরে তাকালেন না। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এ হলো পার্থিব জগত। মহানবী (স.)-এর দৃষ্টি যেদিকে প্রত্যাখ্যাত সেসব মতবাদের দিকে আজ আমাদের মুসলমানদের আগ্রহ ও মোহ। এর পেছনেই আজ বিশ্বের দেশে দেশে যতসব মুসলিম অনৈক্য ও আত্মহানাহানি! এর পর এক বৃদ্ধা নারী সামনে এলো। জিবরাঈল (আ.) বললেন, দুনিয়ার বয়স এর বয়স থেকে অনুমাণ করে নিন। এর পর আরও একটি লোক এলো, লোকটিও তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইল। কিন্তু রাসূলে করীম (স.) তাকে অতিক্রম করে আগে অগ্রসর হলেন। জিবরাঈল (আ.) বললেন, এ ছিল শয়তান। এর অভিপ্রায় ছিল আপনাকে বিপথগামী করা।
বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছে তিনি বুরাক থেকে নেমে গেলেন। এখানে তিনি সেই জায়গায় বুরাক বাঁধলেন, যেখানে অন্যান্য নবীগণও বাঁধতেন। হায়কালে সুলায়মানীতে প্রবেশ করলে সৃষ্টির শুরু থেকে আরম্ভ করে ওই সময় পর্যন্ত যত নবী-রাসূল (আ.) দুনিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছেন, সকলকে এখানে উপস্থিত পেলেন। তিনি এখানে পৌঁছা মাত্রই নামাজের কাতার দাঁড়িয়ে গেল। ইমামতি করার জন্য কে আগে অগ্রসর হবেন, সকলে এই অপেক্ষায় ছিলেন। জিবরাঈল (আ.) হাত ধরে তাঁকে আগে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি সকলের নামাজ পড়ালেন, হলেন নবীদের নবী, ইমামদের ইমাম, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া। এর পর একটা সিড়ি তাঁর সামনে পেশ করা হলো। জিবরাঈল (আ.) তাঁকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আকাশের দিকে চলে গেলেন। আরবি ভাষায় সিঁড়িকে মিরাজ বলা হয় এবং সামঞ্জস্যের কারণে এই পূর্ণ ঘটনা মিরাজ নামে খ্যাত হয়েছে ।
প্রথম আকাশে পৌঁছে তারা দরজা বন্ধ পেলেন। দ্বাররক্ষী ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলেন- কে আসছেন? জিবরাঈল তার নিজের নাম বললেন। জিজ্ঞেস করলেন আপনার সঙ্গে কে আছেন? উত্তরে জিবরাঈল (আ.) বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। তারা জিজ্ঞেস করল, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? বললেন, হ্যাঁ ডেকে পাঠানো হয়েছে। তারা দরজা খুলে দিলেন। এখানে হৃদয় নিংড়ানো সংবর্ধনা জানানো হলো। এখানে অবস্থানরত ফেরেশতাকুল ও মহামানবদের রুহের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো।
এখানে এঁদের মধ্যে খুবই শানদার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের একজন মহামানব ছিলেন। মানবীয় গঠনের পরিপূর্ণ নমুনা ছিলেন তিনি। জিবরাঈল (আ.) বললেন, ইনি হলেন আদম (আ.)। আপনার সর্বপ্রথম পূর্বসূরি। এই মহামানবের আশপাশে আরও অনেক লোক ছিলেন। তিনি ডান দিকে তাকালে খুশি হতেন, আর বাঁ দিকে তাকালে কেঁদে ফেলতেন। জিজ্ঞেস করলেন এর রহস্য কি? উত্তরে বলা হলো, এরা আদম সন্তান। আদম (আ.) তাঁর নেক সন্তাদের দেখে খুশি হতেন। আর খারাপ সন্তানদের দেখলে কেঁদে ফেলতেন। তারপর তাঁকে বিস্তারিত দেখার সুযোগ দেওয়া হলো। এক জায়গায় তিনি দেখলেন কিছু লোক ফসল কাটছে। আর যত কাটে ততই তা বেড়ে চলে। জিজ্ঞেস করলেন, এঁরা কারা? উত্তরে বলা হলো, এঁরা আল্লাহর পথে জিহাদ করতেন। তারপর দেখলেন, পাথর দিয়ে কিছু লোকের মাথা চুর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? বলা হলো যাদের অলসতা তাদের নামাজ পড়ার জন্য উঠতে দিত না। আরও কিছু লোক দেখলেন, যাদের পোশাকের সামনের ও পেছনের দিকে তালি লাগানো ছিল। তারা জানোয়ারের মত ঘাস খাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? বলা হলো এরা মালের যাকাত-খয়রাত কিছুই দিত না।
মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, মিরাজের ঘটনার প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সামনে শাবান এবং পরবর্তী মাহে রমজান। এ মৌসুম আমাদের ইসলাহের সংশোধনের সতর্কতার সুযোগ এনে দিয়েছে। মিরাজ রজনীতে নেক্কার মানুষদের সুখকর অবস্থা আর বদকার মানুষদের শাস্তির চিত্র আমাদেরকে তওবা, অনুশোচনার ও সংশোধনের অনুপ্রেরণা যোগায়।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব