
ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল এখন অনেকটাই মানুষের দোরগোড়ায়, হাতের মুঠোয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলেন ২০০৮ সালে। নিয়েছিলেন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেমনটি করেছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদ। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এখন স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হতে যাচ্ছে তারই স্মার্ট নির্দেশনায়। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটির সমন্বয়ে হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।
যেখানে থাকবে না ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, থাকবে সকলের বাসস্থান ও কাজের নিশ্চয়তা, নাগরিক হয়ে উঠবে মানবিক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে, দেশ গঠনে থাকবে সকলের সমান অবদান। মান-মর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধে হয়ে উঠবে উন্নত বিশ্বের সমান। যদিও পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ তাদের দেশকে স্মার্ট হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করেছে ৬টি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে- স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইনভায়রনমেন্ট, স্মার্ট লিভিং, স্মার্ট মবিলিটি এবং স্মার্ট সিটিজেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত এই চারটি স্তম্ভের মধ্যেই উন্নত বিশ্বের ছয়টির দিকনির্দেশনা নিহিত রয়েছে।
এই দিকনির্দেশনাগুলো কি তা এবার বুঝতে চেষ্টা করি। সাধারণ নাগরিকরা যখন একটি টেকসই ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে নিজেদের তথ্য আদান-প্রদানে দক্ষ ও সক্ষম হয়, তখনই তাদেরকে ‘স্মার্ট সিটিজেন’ বলা হয়। প্রযুক্তির মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যাগুলোর সমাধান ও সিদ্ধান্ত নিতে এবং ডিজিটাল স্বাক্ষর যুক্ত নথি আদান-প্রদানে স্মার্ট নাগরিক এবং সিটির পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং মানসিকতা হবে এক ও অভিন্ন।
আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক্ষেত্রে জরুরি তা হলো- প্রথমত, সরকারি এবং বেসরকারি খাতে তথ্য বা পরিষেবার মাধ্যমে নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়কে রূপান্তরিত করা। সামাজিক এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিতে সমতা তৈরি করে সকলের জন্য তথ্য এবং পরিষেবায় দক্ষ ও সহজবোধ্য নিয়ম চালু করা। দ্বিতীয়ত, শ্রমবাজারের সুযোগ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সকল বয়সের জনসংখ্যার জন্য আজীবন ব্যবহারযোগ্য স্মার্ট অবকাঠামো তৈরি। তৃতীয়ত, স্মার্ট সিটিজেন একটি শহর বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সমৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য অ্যাক্সেসযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা।
স্মার্ট ইকোনমি একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে। সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি, স্টার্ট-আপ ও বিনিয়োগকারীর জন্য লোভনীয়, আকর্ষণীয় এবং প্রতিযোগিতামূলক উদ্ভাবনী পন্থা বাতলে দেয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে, যা সমস্ত স্টেকহোল্ডারের জন্য স্থিতিশীল এবং অনুকূল পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়তা করে।
স্মার্ট ইকোনমিতে নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সম্পদের দক্ষতা, স্থায়িত্ব এবং উচ্চ সামাজিক কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে একটি টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি এমনভাবে দাঁড় করায়, যেখানে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে উৎপাদন ও প্রতিযোগিতা বাড়ায়, নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। এতে নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, পণ্যের গুণগত মান এবং মূল্য নির্ধারণে উন্নত বিশ্বের সমতুল্য হয় এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সমতা আনে। স্মার্ট দৃষ্টিকোণ থেকে উপরোক্ত সুযোগগুলো প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে এবং তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতাসহ পণ্য বেচাকেনা হয় ক্যাশ-লেস্ট্রানজেকশনে।
স্মার্ট গভর্ন্যান্স বলতে বোঝায় সহজ, জবাবদিহিমূলক, প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বচ্ছ শাসন। এক্ষেত্রে আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের নীতি-নির্ধারণ, পরিধান ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণসহ একটি ব্যবহারবান্ধব সরকারের রূপরেখাকে বোঝায়। স্মার্ট গভর্ন্যান্সে আরও যেসব সেবা নিহিত থাকে সেগুলো হলো- স্বচ্ছ রিপোর্টিং, সচেতনতা বৃদ্ধি, জনসাক্ষরতা ও জনসম্পৃক্ততা, আন্তঃবিভাগের সমন্বয়ে অপারেশনাল কম খরচ এবং কর্মক্ষেত্রের সর্বস্তরে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহারে নিশ্চিত করা।
অর্থাৎ সরকার এবং সমস্ত স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সংযোগ এবং মিথস্ক্রিয়া জোরদার করা। প্রযুক্তিনির্ভর একটি স্মার্ট কৌশল অনুসরণ করে সরকার এমন একটি গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে, যেখানে সমস্ত অংশীজনের পরিষেবার গুণগত মান, স্কেল এবং সুবিধাগুলো সহজে ব্যবহার ও পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকে। এখানেও নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছতা, বিশ্বাস এবং আস্থায় সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত হয়।
পরিশেষে স্মার্ট সোসাইটির কথায় আসি- পৃথিবী একটি অবিশ্বাস্যভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। ক্রমবর্ধমান ও বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যার ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ব আজ এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে ব্লাড প্রেসার সেন্সর পর্যন্ত সবকিছুতেই মানুষ এমনভাবে প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে যে, গত তিন বছরে এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য/ডাটা উৎপন্ন হয়েছে, যা সমগ্র মানব ইতিহাসে হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে ‘স্মার্ট সোসাইটি’ ক্রমবর্ধমান সকল চ্যালেঞ্জ যেমনÑ প্রয়োজনীয় এবং মানসম্মত খাদ্য, পানি, চিকিৎসা ও শক্তি সরবরাহের জন্য পরিবেশগত উদ্বেগের পাশাপাশি পরিবহন, অবকাঠামো মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকে। কারণ একমাত্র স্মার্ট সোসাইটিই এই সমস্যাগুলোর দিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নজর রাখতে পারে। উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অপর স্মার্ট সোসাইটি, সম্প্রদায় এবং অভিজ্ঞ নেতৃত্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম।
স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট, স্মার্ট লিভিং, স্মার্ট মোবিলিটি ইত্যাদি সবই একে অপরের পরিপূরক। স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ন্ত্রক। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে সমর্থন করে বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস, দূষণ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব নতুন নগরায়ন এবং স্মার্ট সম্প্রদায় তৈরি করা ইত্যাদি স্মার্ট এনভায়রনমেন্টের লক্ষ্য।
স্মার্ট লিভিংয়ের লক্ষ্য হলো সমস্ত বয়সের গোষ্ঠী এবং জনসংখ্যার মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (যেমনÑ ইলেকট্রনিক পরিষেবা, সংযোগ এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার) পদ্ধতিতে নাগরিক এবং দর্শনার্থীদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা, যতœ, নিরাপত্তা, আবাসন উন্নতিতে মনোনিবেশ। স্মার্ট মোবিলিটি শহরে পরিবহন ও পরিষেবার মান বাড়ায়। সস্তা, দ্রুত এবং পরিবেশবান্ধব বন্ধুত্বপূর্ণ মাল্টি-মোডাল পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। সেজন্য পাবলিক ও প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টের একাধিক মোডের সমর্থনে পরিবহনে নতুনত্ব থাকে।
এটি সমস্ত নাগরিক, ব্যবসা এবং দর্শকদের জন্য একটি গ্রাহক-কেন্দ্রিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি, যা একটি শহর বা সম্প্রদায়ের মধ্যে মানুষ এবং পণ্যের প্রবাহ উন্নত এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করে। এগুলো ছাড়াও স্মার্ট দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমনÑ মার্কেট, রেল-বাস-লঞ্চ স্টেশন, বিমানবন্দর, হাসপাতাল, পার্ক সর্বত্র থাকে ফ্রি ওয়াইফাই। সর্বত্র সিনিয়র সিটিজেন, গর্ভবতী মহিলা, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকে বিশেষ অগ্রাধিকার ব্যবস্থা।
যাতায়াতের জন্য সমস্ত স্টেশনগুলো থাকে অত্যাধুনিক গণপরিবহনের আওতায়। রাস্তাঘাট থাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং শব্দহীন। দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খুলে এবং বন্ধ হয়। সরকারি-বেসরকারি চাকরির বেতনে থাকে না পার্থক্য। থাকে না চাঁদাবাজি, অপরাধ। ফলে পুলিশ থাকে দর্শকের ভূমিকায়।
উপরোক্ত সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে স্মার্ট দেশ হিসেবে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর, জাপান, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলারুশ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, চীনসহ আরও অনেক দেশ। যে মেট্রোরেল আমাদের দেশে ২০২২ সালে যাত্রা করেছে, তা হাঙ্গেরিতে ১৮৯৬ সালে, লন্ডনে ১৮৬৩ সালে, প্যারিসে ১৯০০ সালে, বার্লিনে ১৯০২, নিউইয়র্কে ১৯০৪ সালে, জাপানে ১৯২৭ সালে, ভারতে ১৯৮৪ সালে এবং লাহোরে ২০২০ সালে শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশে উন্নয়নের এই যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সালে কালিয়াকৈরে প্রথম হাইটেক পার্ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে। স্মার্ট শিক্ষা, যোগাযোগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না- বরং স্মার্ট বিশ্ব নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখবে আগামীতে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়