ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কাতার বিশ্বকাপে চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তি

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৩৮, ২১ নভেম্বর ২০২২

কাতার বিশ্বকাপে চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তি

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে কাতার ২০২২-বিশ্বকাপ

বিশ্ব এখন কাঁপছে বিশ্বকাপ জ্বরে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে গোটা বিশ্বই যখন প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে, তখন বিশ্বকাপ আয়োজনে নতুন নতুন প্রযুক্তির চমক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠানের আয়োজন আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে কাতার ২০২২-বিশ্বকাপ। অনেক প্রথমের সাক্ষী হতে যাচ্ছে ফুটবল দুনিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াই। এমন সব প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে যা আগে কখনো দেখেনি গোটা বিশ্ব। খেলোয়াড়দের ক্রীড়ানৈপুণ্যে, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স, মানসিক স্বাস্থ্য, বিতর্কিত ও জটিল সিদ্ধান্তগুলো সঠিক ও নিখুঁতভাবে দ্রুত সময়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য যুক্ত হয়েছে মোবাইল অ্যাপস এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।

খেলায় নানা উত্তেজনা ও হইচই কা-ে খেলোয়াড়রা  যথেষ্ট মানসিক চাপে থাকে। তাই খেলোয়াড়সহ ফুটবল কমিউনিটির মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য যুক্ত করা হয়েছে অ্যাপ ‘কাম (ঈধষস)’। আগামী বছর মহিলাদের বিশ্বকাপ এবং নেশনস কাপেও চালু থাকবে এই অ্যাপস। ফিফার উদ্যোগে পুরুষ এবং মহিলা উভয় বিশ্বকাপেই অংশগ্রহণকারী ফুটবলার, কোচ, ট্রেনিং স্টাফরা বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন এই কাম অ্যাপ। তবে ফুটবলারদের পাশাপাশি ফুটবল ভক্তদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে পরিচর্যার সুযোগ থাকছে অ্যাপসে। সে জন্য ৫০ শতাংশ ছাড়ে ফিফার বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে ফুটবল ভক্তরা।
ম্যাচ শেষে দ্রুততম সময়ে নিজের পারফরম্যান্স জানতে যুক্ত হয়েছে ‘ফিফা প্লেয়ার্স অ্যাপ’। ফিফপ্রোর সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেছে এটি ফিফা। প্রতিটি ম্যাচের পরই প্রত্যেক খেলোয়াড়কে তাদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স, ডেটা অ্যাক্সেস করার সুযোগ দেবে। শুধু তাই নয়, ম্যাচে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের ডেটা সিনেক্রোনাইজ করা হবে, যাতে খেলোয়াড়রা বিভিন্ন ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব পারফরম্যান্সের সমস্ত মুহূর্ত বিস্তারিতভাবে দেখতে পারেন। খেলা এবং খেলোয়াড়দের  পারফরম্যান্স সম্পর্কিত ফিফার উচ্চ প্রশিক্ষিত কোচদের চমকপ্রদ বিশ্লেষণ, ডেটা আর ট্র্যাকিং ডেটার সম্মিলিত তথ্য ভা-ার থাকবে এই অ্যাপসে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাস দেওয়া বা রিসিভ করার সময় বল দখলে প্রতিপক্ষ কী পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করেছে, কৌশল খাটিয়ে কিভাবে বল নিজের আয়ত্তে এনেছে ইত্যাদি। স্টেডিয়ামের চারপাশের ক্যামেরার ইন-ট্রাফিকিংয়ের মাধ্যমেও মাঠে থাকা খেলোয়াড়দের ডেটা সংগ্রহ হবে। কত গতিতে কতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করলেন একজন ফুটবলার, ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটারের বেশি গতির অ্যাকশন সংখ্যা, সর্বোচ্চ গতি, পজিশনাল হিট ইত্যাদি তাৎক্ষণিক দেখতে পাবেন খেলোয়াড় এবং দর্শকরা। ম্যাপ ও ভিজুয়াল পদ্ধতিতে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম এসব ইনসাইট ডেটাকে বিশ্লেষণ করে অ্যালগরিদম এবং মডেলে ফেলা হবে। অ্যাপসের এই অংশটির নাম ‘ফুটবল ডেটা মেট্রিক্স’।

ফুটবলে অফসাইড নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। রেফারি ছাড়াও এখন ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফার মাধ্যমে সহজেই অফসাইড ধরা যায়। এরপরও এর সুনিপুণতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে। নির্ভুলতা কমিয়ে আনতে কাতার বিশ্বকাপে নতুন ‘সেমি অটোমেটেড’ অফসাইড প্রযুক্তির ব্যবহার থাকছে। উন্নত মানের ‘ভিএআর’  এর  সাহায্যে মাত্র ২৫ সেকেন্ডেই অফসাইডের সিদ্ধান্ত দিতে পারবে, যা আগে লাগত ৭০ সেকেন্ড। প্রযুক্তিটি কার্যকর করতে বলের মাঝখানে  এমন সেন্সর ব্যবহৃত হয়েছে, যা প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার ডাটা পাঠাতে সক্ষম এবং নিখুঁত কিক পয়েন্ট নির্ধারণ করতে সক্ষম।

বল নজরদারিতে রাখার জন্য স্টেডিয়ামের ছাদে ১২টি শতভাগ সিনক্রোনাইজড মাল্টি ট্রাকিং ক্যামেরা লাগানো আছে। বল ছাড়াও ক্যামেরাগুলো খেলোয়াড়দের  শরীরের ২৯ পয়েন্টের নজরদারি এবং নিখুঁত অবস্থান প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার ডাটা পাঠাতে পারবে। যদি কোনো খেলোয়াড় অফসাইডে থাকেন, তাহলে সেন্সরটি প্রথমে ভিএআর বুথকে সংকেত দেবে। গত বছর  আরব কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপ দিয়ে সিস্টেমটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

কাতারের মরুর বুকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে তাপমাত্রা- এই প্রশ্ন অনেকেরই। তার জন্য বিশেষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে কাতার। তৈরি করেছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সাত স্টেডিয়াম। ড. কুল নামের এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে কাতার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে নামÑ ‘নাইন সেভেন ফোর (৯৭৪)’। নম্বরটি মূলত কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়াল কোড। এর সঙ্গে মিল রেখেই ৯৭৪টি কন্টেনার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে স্টেডিয়ামটি। ৪০ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে এই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে পারবেন।

কাতারের ইতিহাস, সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সর্বোপরি কাতারিদের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা জানাতেই তৈরি হয়েছে এই মাঠ। রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ১০ কি.মি. পূর্বে অবস্থিত উপকূলীয় শহর রাস-আবু আবাউদে নির্মিত এই বিশেষ স্টেডিয়ামটি ভেঙে ফেলা হবে বিশ্বকাপের আসর শেষেই। সমুদ্র তীরে অবস্থান হওয়ায় স্টেডিয়ামটিতে প্রয়োজন নেই এয়ার কুলারের। পাইপলাইনের মাধ্যমে আনা হবে ঠাণ্ডা বাতাস।
ভিডিও এসিসটেন্ট রেফারেন্স (ভিএআর) প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা গেছে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে রাশিয়ায়। এটি খেলার ভিডিও রিপ্লের মাধ্যমে মাঠের রেফারিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে মাঠের বাইরে থাকা স্টুডিওতে বিশেষ একটি টিম ভিডিও রিপ্লে বিশ্লেষণ করে। ক্রিকেট খেলায় এ ধরনের প্রক্রিয়া অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মূলত রেফারির নেওয়া বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত আরও নির্ভুল করার জন্যই এই সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। যেমন- গোল হয়েছে কি না এবং গোল করার প্রক্রিয়ার মাঝে কোনো নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে কি না; পেনাল্টি ও লাল কার্ড দেওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত ইত্যাদি।

যখনই মাঠে হেড রেফারি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হন, তখন তিনি হেডসেট দিয়ে ভিএআরকে রিভিউ করার জন্য বলতে পারবেন (অথবা ক্রিকেটের মতো হাত দিয়ে টিভি রিপ্লে সঙ্কেত দিতে পারবেন)। ভিডিও ফুটেজ দেখার সময় ভিএআর টিম যদি মনে করে যে, হেড রেফারিকে রিভিউ রিকমেন্ড করা উচিত, তাহলে তারা তা হেডসেটের মাধ্যমে জানাতে পারবেন। এই টেকনোলজি ব্যবহারে খেলার ফলাফল ও বিচারকার্যে আরও স্বচ্ছতা আসে।
ব্রাজিল ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে সেদেশের ১২টি স্টেডিয়ামের প্রতিটিতে  প্রথমবারের মতো গোললাইন-প্রযুক্তি (জিএলটি) ব্যবহার করে। অবশ্য ২০১২ সালেই আনুষ্ঠানিকভাবে জিএলটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড (আইএফএবি)। উল্লেখ্য, জার্মানির বিরুদ্ধে ইংলিশ দলের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্প্যার্ডের একটি সুস্পষ্ট গোল নিয়ে ২০১০ সালের বিশ্বকাপে (দক্ষিণ আফ্রিকা) চরম বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ল্যাম্প্যার্ডের সেই ঘটনার প্রেক্ষিতেই তখন জিএলটি প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। এবারের বিশ্বকাপেও থাকছে জিএলটি, তবে আরও আধুনিক হয়ে ১৪টি ক্যামেরার সমন্বয়ে।

এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে থ্রিডি ভিশন দেখতে পাবেন সমর্থকরা। ২০১৪ সালে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় এই প্রযুক্তির সঙ্গে। প্রসঙ্গত, ‘হক-আই’ হচ্ছে একটি ব্রিটিশ ক্যামেরাভিত্তিক ব্যবস্থা এবং ফিফা লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রথম কোম্পানি। এই ক্যামেরা ব্যাপকভাবে সবচেয়ে সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং অভিজ্ঞ জিএলটি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ডা. পল হকিন্স, যিনি ক্রিকেট, স্নুকার এবং টেনিসে ব্যবহৃত বল-ট্রাকিং ডিভাইস আবিষ্কার করেন, এই ক্যামেরার সঙ্গে সমন্বয় করে ফুটবলেও বল-ট্রাকিং করার ধারণা দেন।

আর ‘গোল-রেফ’ হলো ড্যানিশ-জার্মান প্রযুক্তি, যা বিতর্কিত বলের গতিপথ নির্ধারণে গোলপোস্টের সঙ্গে চৌম্বকীয় সেন্সর ব্যবহার করে নিখুঁত ইমেজ প্রদর্শন করে। এর বাইরেও থাকছে ‘হায়া কার্ড’, যা ম্যাচের দিন টিকিটধারীদের বিনামূল্যে গণপরিবহন ব্যবহারসহ বিভিন্নরকম সুবিধা দেবে। তাছাড়াও হায়া কার্ড আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য কাতারে এন্ট্রি পারমিট হিসাবে কাজ করবে। বিশ্বকাপের ম্যাচের টিকিটধারীরা ‘ঐধুুধ ঃড় ছধঃধৎ ২০২২’ ওয়েবসাইট থেকে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বুকিং দিতে পারছেন সহজেই।
খেলার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরো দেশটাই থাকবে ১৫ হাজার ক্যামেরার  নজরদারিতে। খুঁজবে অপরাধীকে। এস্পায়ার কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার নজরদারিতে থাকছে এক মিলিয়ন ভ্রমণকারী। প্রযুক্তি হলো লাইভ-ট্রাকিং পারফরম্যান্সের মাধ্যমে ক্রীড়া নৈপুণ্যের বিপ্লব ঘটানো, যা স্টেডিয়ামের বাইরে থাকা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দর্শকদের প্রাণের খোরাক। এটাকে মাথায় রেখেই ব্রাজিলে ব্যবহৃত হয়েছে গোল-লাইন-টেকনোলজি (২০১৪), রাশিয়ায় ভিএআর (২০১৮), আর এবার (২০২২) কাতারে থাকছে ‘সেমি অটোমেটেড’ অফসাইড এবং অ্যাপস প্রযুক্তি। ফলে, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগের চেয়ে অনেক কম সময় লাগবে। খেলা হবে আরও নিখুঁত, স্বচ্ছ, জীবন্ত ও গতিময়, প্রযুক্তির সমন্বয়ে কাতারে  এক নতুন  যুগের সূচনা করেছে, যা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনকে পথ দেখাবে  আগামীতে।


লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×