ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নোবেলের দেশ থেকে

মহাত্মা গান্ধীকে কেন দেয়া হয়নি নোবেল শান্তি পুরস্কার

দেলওয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

মহাত্মা গান্ধীকে কেন দেয়া হয়নি নোবেল শান্তি পুরস্কার

মহাত্মা গান্ধীকে কেন দেয়া হয়নি নোবেল শান্তি পুরস্কার

পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই কারও মুখে ‘গান্ধী’ নামটি উচ্চারিত হলে আর কোন পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যেমন পড়ে না চন্দ্র, সূর্য , গ্রহ, তারকা ইত্যাদির ক্ষেত্রে। দুনিয়ার বুকে এমনিভাবেই তার নামটি শাশ্বতকালের জন্য একটি আইকনে পরিণত হয়েছে। তিনি কোন দেশ-কালের মধ্যে আবদ্ধ নন। তিনি তার কর্মের মহীমায় আলোকিত হয়েছেন জগতব্যাপী। সেই আলোর দ্যুতিতে তিনি সমুজ্জ্বল। তিনি কালজয়ী। শান্তি আর অহিংসবাদ ছিল তার রাজনীতি ও জীবনদর্শনের মূলমন্ত্র। অহিংসাকে অস্ত্র হিসেবে ধারণ করে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামে।
শাসকগোষ্ঠীর জেল-জুলুম, অত্যাচার-নিপীড়ন, খুন, লুণ্ঠন, জবরদখল, ষড়যন্ত্র, ফাঁসি ছাড়াও হেন কোন অপকর্ম সংঘটিত হয়নি ব্রিটিশ শাসনকালে যার ইতিহাস কারও অজানা। সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নিরলস লড়াইয়ে গান্ধীর ছিল মাত্র একটিই হাতিয়ার- অহিংসবাদ। এর মধ্য দিয়েই তিনি করেছেন শান্তির অন্বেষা। তা করতে গিয়ে ভারতবাসীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে কড়ায়-গ-ায়। তবুও গান্ধী সরে আসেননি তার আদর্শিক অবস্থান থেকে। শেষমেশ জীবন দিয়ে তিনি পরিশোধ করে গেছেন শান্তির মূল্য। সে মূল্য পরিশোধ করেই তিনি পৃথিবীর আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন চির বরেণ্য, প্রাতঃস্মরণীয়।
যে শান্তির জন্য তার জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ, দুর্ভাগ্যজনক ও নিষ্ঠুর হলেও সত্য, শান্তির পদক বা স্বীকৃতি হাতে পাওয়ার আনুষ্ঠানিক কাগুজে ট্যাগ লাগেনি তার কপালে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও মর্যাদাসম্পন্ন নোবেল শান্তি পুরস্কারে শিকে ছেঁড়েনি তার ভাগ্যে। জুটেছে মানুষের অনিন্দ্য ভালবাসার বরমাল্য। তা দিয়েও মানুষের তৃপ্তির ষোলোকলা পূর্ণ হয়নি। শান্তি পুরস্কার থেকে গান্ধীকে বঞ্চিত করে নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে লেখা হয়েছে একটি নিষ্ঠুর বঞ্চনার অমোচনীয় কলঙ্কের উপাখ্যান।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তিনি বারবার মনোনীত হয়েও ছিটকে পড়েছেন চূড়ান্ত তালিকা থেকে। ৭০ বছর অতিক্রান্ত হবার পর এই বঞ্চনার ইতিহাস আজও সমানভাবে হয়ে আসছে নিন্দা ও গভীর অনুশোচনার সঙ্গে আলোচিত। হয়ত শতাব্দী পার হয়ে যাবে, তারপরেও এই কালিমা মোচন হবে কি না, তা কারও জানা নেই। গান্ধীর নোবেল বঞ্চনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই সেই নিষ্ঠুর সত্যগুলো উঠে আসে।
 ভারতের অহিংস আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ শান্তিবাদী নেতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী (জন্ম- ১৮৬৯, মৃত্যু- ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮) ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে মোট ৫ বার চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েও নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেননি। অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে- ভারতশাসক ব্রিটিশ রাজের অসন্তোষ, রাজনৈতিক বিদ্বেষ, মতানৈক্য ও কোটারিগত স্বার্থ দ্বারা তাদের অনুগত নোবেল কমিটি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণেই বঞ্চনার শিকার হন গান্ধী।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে এই কলঙ্কিত অধ্যায় কখনও মোচনীয় নয় বলে শোনা যায় সর্বমহলে। খোদ নোবেল কমিটির ভেতরে-বাইরে জনে জনে রয়েছে অনুযোগের ফিরিস্তি ও আত্মদহনের জ্বালা। এ প্রসঙ্গে ২০০৬ সালে খোদ নোবেল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক গেইর লুন্দেস্তাদ গান্ধীকে শান্তি পুরস্কার দিতে না পারায় তার অনুশোচনা ব্যক্ত করে বলেন, ‘নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে বড় একটি বিষয় বাদ পড়ে গেছে।’
১৯৪৮ সালে গান্ধী মনোনয়ন দাখিলের শেষ তারিখ ৩১ জানুয়ারির দুদিন আগে ভারতে ঘাতক নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হন। এ বছরটি তার পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল অনুকূলে। তাকে মরণোত্তর পুরস্কার দানের কথা উঠলেও কমিটি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।

১৯৩১ সালে সুইডিশ নাগরিক এরিক আক্সেল কার্লস্টেডকে সাহিত্যে এবং ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব সুইডিশ নাগরিক দ্যাগ হামারশোল্ড আফ্রিকার দেশ কঙ্গো মিশনে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে ঐ বছর তাকে মরণোত্তর শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় বিধান লঙ্ঘন করে। আগে অনিয়মের রেকর্ড থাকলেও গান্ধীর ক্ষেত্রে কেন তা অনুসরণ করা যাবে না দীর্ঘদিন সেই প্রশ্ন চলতে থাকলে সদুত্তর দিতে ব্যর্থ বিব্রত নোবেল কমিটি। ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মতো পরিস্থিতির শিকার হয়ে ১৯৭৪ সালে নোবেল কমিটি ঘোষণা দিয়ে মরণোত্তর প্রথা বাতিল করে।

তবে ১৯৮৯ সালে তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামাকে যখন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তখন গান্ধীর বঞ্চনার প্রসঙ্গটি তুলে এর বিরোধিতা করা হয়। পরবর্তী কমিটির সদস্যরা প্রকাশ্যে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। ঐ সময় নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বলেছিলেন- দালাই লামার এই পুরস্কারটি মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি আংশিক শ্রদ্ধা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে।
এই বিষয়টিই জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্কে। সেই প্রসঙ্গটি এখানে আলোচনার দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে এখনও প্রশ্ন তোলা হয়, নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দৃষ্টিভঙ্গি কি এতটাই সঙ্কীর্ণ ছিল যে, তারা একটি অ-ইউরোপীয় দেশের স্বাধীনতা ও তার নেতাকে মেনে নিতে যথেষ্ট কুণ্ঠিত ও শঙ্কিত ছিল? গান্ধীকে শান্তি পুরস্কার দেয়া হলে ব্রিটেনের সঙ্গে নরওয়ের দুই রাজতন্ত্রের দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেই নরওয়ে ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’র মতো সঙ্কটে পড়ে। অথবা ব্রিটেনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব নরওয়ের উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলেও জনশ্রুতি ভেসে বেড়ায়।
গান্ধীর আদর্শের অনুসারী ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া এ্যাসোসিয়েশন নামের নেটওয়ার্কের একটি শাখা ১৯৩০ সালের গোড়ার দিকে ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গঠিত হয়েছিল, যা ভারতের বিভিন্ন মতধারার মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়। ধর্মীয় মতবাদের একটি গোষ্ঠীর কাছে গান্ধী বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। অহিংসবাদী ও মানবিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানুষগুলো সমবেত হয়েছিল এখানে। তারাই তাকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে সমর্থন দেয়।
১৯৩৭ সালে নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্টের (স্টুর থিং) লেবার পার্টির সংসদ সদস্য উলে কোল বিওর্নসন মনোনয়নদানের ক্ষমতা বলে নাম প্রস্তাবের মাধ্যমে ১৩ জনের শর্ট লিস্টে গান্ধীর নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। এর জন্য মোটিভেশন এবং তার অনুকূলে জোরালোভাবে কাজ করেছিলেন ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়ার নরওয়েজিয়ান শাখার নেতৃস্থানীয় মহিলাগণ। মনে করা হয়েছিল ইতিবাচক সম্ভাবনার কথা। হয়নি।
নোবেল কমিটি এবং এর উপদেষ্টা অধ্যাপক ইয়াকব ওয়ার্ম মুলার যে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন তা ছিল গান্ধীর প্রশংসা ও সমালোচনায় ভরা। তিনি লিখেছেন- গান্ধী নিঃসন্দেহে একজন ভাল, মহৎ ও বিশিষ্ট তপস্বী ব্যক্তি। ভারতীয় জনগণের কাছে তিনি যেমন সম্মানিত, তেমনি বিপুল জনপ্রিয়। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তিনি তাকে মূল্যায়ন করেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিপরীতমুখী সত্তার ব্যক্তি হিসেবে। তিনি লিখছেন- তার কার্যকলাপ দ্রুত পরিবর্তনশীল, যাকে তার অনুসারীরাও বুঝে উঠতে পারেন না। অনেকটা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য প্রকৃতির।

একদিকে তিনি জাতীয়তাবাদী, আদর্শবাদী এবং অপরদিকে স্বৈরশাসক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি কখনও খ্রীস্টান ধর্মাশ্রয়ী আবার পরক্ষণেই রাজনীতিক। তিনি কখন কোন সত্তায় আবির্ভূত হন তা অনুমান করাও মুশকিল। তবে শেষতক ১৯৩৭ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন ব্রিটিশ রাজনীতিক ও কূটনীতিক চেলউডের লর্ড সিসিল এডগার আলগারনন রবার্ট গ্যাস্কোয়েন, লীগ অব নেশনসের শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরস্ত্রীকরণ কাজে অবদান রাখার জন্য।
কথিত আছে, ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে নোবেল কমিটির উলে কোল বিয়র্নসন ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে গান্ধীকে মনোনয়নের শর্ট লিস্টে রেখেছিলেন। তবে দুর্ভাগ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪০, ১৯৪১ ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে কোন শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়নি। এমনকি শেষবারের মতো ১৯৪৮ সালে গান্ধীর নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনার আলো দেখা দিলেও নানা জটিলতায় সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় গান্ধীর সেই সম্ভাবনাও চিরতরে ধূলিসাত হয়ে যায়।
১৯৪২ সালে নরওয়েজিয়ান পররাষ্ট্র দফতরের মাধ্যমে গান্ধীর মনোনয়নের আবেদনপত্র আসে। মনোনয়ন প্রস্তাব করেছিলেন বি, জি, খের, বোম্বের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, ইউনাইটেড প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মাভালাঙ্কার, ভারতীয় আইনসভার সভাপতি প্রমুখ। গোবিন্দ বল্লভ গান্ধীর প্রার্থিতার পক্ষে লিখেছিলেন- নীতি আদর্শ ও শৃঙ্খলার অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত ও বিশ্ব শান্তির চ্যাম্পিয়ন মডেল, ভারতীয় জাতির স্থপতি গান্ধীকে এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করুন। এ বছর শর্ট লিস্টে ছিল ৬ জনের নাম। গান্ধী ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।

নোবেল কমিটির উপদেষ্টা ইতিহাসবিদ ইয়েন্স উরুপ সেইপ তার এক প্রতিবেদনে গান্ধীর রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ১৯৩৭ সালের ভূমিকা সম্পর্কে লেখেন- সেই সময় থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বছরের পর বছর গান্ধীর পুরস্কারের জন্য আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন সরব। একে একে প্রত্যাশার সব বছর পাশ কাটিয়ে গেলেও ১৯৪৮ এসেছিল সমূহ সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। এ বছর একটি প্রায় ইতিবাচক ও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছিল নোবেল কমিটি। কিন্তু বিধি বাম!

মনোনয়নপত্র দাখিলে শেষ তারিখের দুদিন আগে ৩০ জানুয়ারি গান্ধী ঘাতকের হাতে নিহত হলে আশার প্রদীপ একেবারে দপ করে নিভে যায়। বিষাদের ঘনঘটায় আলোচনায় যোগ হয় এক নতুন মাত্রা। প্রশ্ন ওঠে মরণোত্তর পুরস্কার দান নিয়ে। এ বছর গান্ধীর মনোনয়নের জন্য ছয়টি চিঠি এসেছিল।


(বাকী অংশ আগামী শুক্রবার)
 লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক
স্টকহোম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
[email protected]

×