ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

পাবলিক সেন্টারে স্থান করে দিতে জাতিসংঘের অনুরোধ

ফের উত্তপ্ত রাখাইন, আরাকান আর্মির নির্যাতনে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচ এম এরশাদ ॥

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৯ মে ২০২৫

ফের উত্তপ্ত রাখাইন, আরাকান আর্মির নির্যাতনে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা

.

বর্তমানে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা। আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) ও জানতা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ এনে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর আবারও  নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছে। ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা রাখাইনে বাড়িঘর ছেড়ে দলে দলে পালাচ্ছে। আসছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। এরপর সুযোগ বুঝে উভয় দেশে দালাল চক্রের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। আশ্রয় নিচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে।
গতবছরের মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। ইউএনএইচসিআর এদের নিবন্ধিত করছে। এ অবস্থায় রাখাইনে থাকা অবশিষ্ট সাড়ে ৩ লাখ রোহিঙ্গার ঢল নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে এবং পরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রিত নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৫ লাখ ছুঁয়ে গেছে। এ সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আশ্রিত শিবিরে রোহিঙ্গা পরিবারে প্রতিমাসে জন্ম নেওয়া গড়ে ৩০ হাজার শিশু। সবমিলে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভারে নতুন করে জর্জারিত উখিয়া টেকনাফ অঞ্চল।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মূলত সীমান্ত পথে চলে আসার সুযোগ ও বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকার সুবাদে রোহিঙ্গারা আবারও বাংলাদেশমুখী হয়েছে। প্রতিদিন ছোট-বড় বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করছে রোহিঙ্গারা।
এদিকে, প্রত্যাবাসন ইস্যু সম্পূর্ণরূপে থমকে যাওয়া এবং উপরন্তু রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির নিপীড়ন নির্যাতন ইতোপূর্বেকার জান্তা বাহিনীর সদস্যদের মতো হওয়ায় রোহিঙ্গা সদস্যদের আগমন ঘটছে। ফলে পরিবেশ পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করার চেষ্টা চলছে। যা ইতোপূর্বে সে দেশের জান্তা বাহিনীর সদস্যরা শুরু করেছিল। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। উখিয়া টেকনাফের ৩২ আশ্রয় শিবিরের স্থান সংকুলান না হওয়ায় নতুনদের স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার, সাইক্লোন শেল্টারসহ বিভিন্ন পাবলিক স্থাপনায় আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। বিষয়টি শুক্রবার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসি) মিজানুর রহমান। তিনি আরও বলেছেন, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এমনিতে আগে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তার ওপর প্রতিদিন নতুন নতুন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও তাদেরকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান কঠিন একটি বিষয়।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানিয়েছে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকছে। এসব পয়েন্টে উভয়পাড়ে রোহিঙ্গা দালালরা কাজ করছে। অত্যন্ত কৌশলে তাদেরকে উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্প এলাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর তাদের থাকা-খাওয়ার কোনো চিন্তা থাকে না। ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা তাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। পরে নিবন্ধিত করে ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের স্থায়ী করার জন্য ১৪ নম্বর ক্যাম্পে সামাজিক বনায়নের পাহাড় কেটে, মাটি ভরাট করে আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওই শেল্টার নির্মাণে আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে কিছু এনজিও। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে আইওএম-এর ডিপোতে লুকিয়ে রাখা কিছু কাঠ জব্দ করেছে বনবিভাগ। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করার কথা বলে শেল্টার নির্মাণ করা হলেও সেখানে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের স্থান করে দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা চালাচ্ছেন স্থানীয় কয়েকটি এনজিও সংস্থা।
এ ব্যাপারে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় ভীতি কাজ করত। কিছু তারা এখন নির্ভয়ে ঢুকছে। আসার পথে কোনো বাধা নেই। বেসরকারি হিসাব মতে, প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা ঢুকছে বাংলাদেশে। স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের মতে, আমরা ধারণা করেছিলাম শীঘ্রই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হবে। অথচ এখন দেখছি তার উল্টো। প্রতিদিন আরও নতুন নতুন রোহিঙ্গা পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে যারা যে ক্যাম্পে যাচ্ছে, তারা সেখানে স্থান পাচ্ছে। আর কিছু রোহিঙ্গা উখিয়া টেকনাফের বাইরে পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ শহর এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত এবং প্রতিনিয়ত রেশন সামগ্রী পেয়ে থাকে এমন ১০ হাজারের বেশি কক্সবাজারের শহর এলাকায় থাকছে। এরা শহর ও শহরতলীতে বসতি গেড়েছে। এদের অধিকাংশ ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছিল। কক্সবাজারের হালিমা পাড়া, কচ্ছপিয়া, জিয়ানগর ও বার্মাইয়া পাড়া এলাকায় এরা বসবাস করে থাকে। সময়মতো ক্যাম্পে গিয়ে ত্রাণ সামগ্রী তুলে এনে খোলা বাজারে বিক্রিও করে দেয়।
স্থানীয়দের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঢলে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ। বর্তমানে আবার শুরু হয়েছে রোহিঙ্গাদের আগমন। এদের কারণে স্থানীয়রা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। শ্রমবাজার, মোটরলাইন ও ব্যবসা বাণিজ্য রোহিঙ্গাদের হাতে চলে গেছে আগে থেকেই। রোহিঙ্গা আগমনে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাদ্দের ২৫ ভাগ প্রদানে সরকারি নিয়মে থাকলেও তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন নতুন আসা রোহিঙ্গাদের স্থান সংকুলানে এলাকার মানুষেরই বড় ক্ষতি হবে বলে তারা মনে করছেন।

প্যানেল

আরো পড়ুন  

×