
সারাদেশে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত অন্তত ৫০ লাখ মানুষ
সারাদেশে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত অন্তত ৫০ লাখ মানুষ। বিটিআরসি ইতোমধ্যে ব্লক করেছে অবৈধ দুই হাজার ৬০০টি জুয়ার সাইট। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা। ছাত্র-যুব সমাজ থেকে শুরু করে অনেক বয়স্ক, রিটায়ার্ড পারসনরাও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। আইপিএল, বিপিএল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপসহ জনপ্রিয় সব খেলা সম্প্রচারকালে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে অনলাইন জুয়া বা বিভিন্ন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন। এসব অনলাইন জুয়ার সাইট রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সাইপ্রাসসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আছে তাদের প্রতিনিধি। অনলাইন জুয়ায় অনেকেই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন মানুষের মুখে মুখে অনলাইন জুয়ার খবর। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে রাস্তার মোড়, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, ভ্যানগাড়িতে বসেও অবাধে চলছে অনলাইন জুয়া। জুয়ার বোর্ড, ক্যাসিনো বা জুয়া খেলার ঘর ছাড়িয়ে জুয়া চলে এসেছে মানুষের ঘরে ঘরে, হাতের মুঠোয়। জুয়া খেলা এখন আর পেশাদার জুয়াড়িদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, লুডু, ক্যারমসহ প্রায় সব ধরনের খেলাধুলায়।
সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ খুঁজে পাচ্ছে নিত্যনতুন জুয়ার আসর। শিক্ষার্থী, যুব সমাজ, কর্মজীবী ধারণ মানুষের হাতে হাতে এখন স্মার্ট ফোন। হুমকির মুখে ছাত্র-যুব সমাজের ভবিষ্যৎ। সন্তানরা মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, নানা অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তার সবকিছুই করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোযোগ নেই, পারিবারিক অজুহাত দেখিয়ে স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টারে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত, জুয়ায় টাকা খুইয়ে মানসিক অশান্তি, খাওয়া দাওয়া, পড়ালেখায় মন নেই, সব সময় মাথায় ঘোরে জুয়ার লাভ-লোকসানের হিসাব।
অনলাইন জুয়ায় যেভাবে প্রতারণা করা হয় তার কিছু উদাহরণ এ রকম : পাত্র চাই, জার্মান ফেরত মেয়ের জন্য। নিজের নামে আছে দুতলা বাড়ি আর তিন বিঘা জমি। ইনসানা রুহি। বয়স ২৯ বছর। ডিভোর্সি। কফিশপ আছে। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। যে কোনো জেলার ভালো একজন পাত্র পেলে বিয়ে করে বিদেশে নিয়ে যাবেন। ‘ফেসবুক কমেন্টে দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করে মোবাইল নম্বর আর ঠিকানা সংগ্রহ করা যাবে।’ লিঙ্কে ক্লিক করলে তা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী মুদ্রা (ফরেক্স) বা ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনা এবং বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার সাইটে।
কখনো নিয়ে যাচ্ছে এমন ওয়েবসাইটে, যেখানে রয়েছে অসংখ্য সুন্দরী মেয়ের ছবি। ছবি নিয়ে ভিডিও কল করুন লেখা বাটনে ক্লিক করলেই নিয়ে যাচ্ছে জুয়ার সাইটে। বাংলাদেশীদের জুয়ায় আকৃষ্ট করতে ফেসবুকে প্রতিনিয়ত দেওয়া হচ্ছে এমন ‘হানিট্র্যাপ’। ফেসবুকে ‘পাত্রী চাই’ লিখে সার্চ করে কয়েক ডজন পোস্ট পাওয়া গেছে। প্রতিটি পোস্টে একটি সুন্দরী মেয়ের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবরণ একই, শুধু কোথাও বয়স বদলেছে, কোথাও পাত্রীর জমির পরিমাণ, আর কোথাও ছবি।
এক ছবি দিয়ে কখনো জার্মানি ফেরত, কখনো ইতালি ফেরত, কখনো লন্ডন ফেরত পাত্রী দেখানো হয়েছে। আর লিঙ্কগুলোয় ক্লিক করলে নিয়ে যাচ্ছে ক্রিকিয়া, জিতবাজ, বাবু ৮৮, বাজি, সিক্স৬ বিডি, সিক্স৬ এসবিডিটি অনলাইনের মতো জুয়ার সাইটে। চলতি বছরের শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল দেশে অন্তত ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত।
অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাব সার্চ করে গত জুলাই থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে ‘বিদেশফেরত পাত্রীর জন্য পাত্র চাই’Ñ এমন ৪৩০টি পোস্ট পেয়েছে। এদের মধ্যে ৩৯৭টি অর্থাৎ ৯২ শতাংশই জুয়া বা বিদেশী মুদ্রা লেনদেনের সাইটে নিয়ে যায়। পোস্টগুলো শেয়ারের পরিমাণও অবিশ্বাস্য। শুধু ফেসবুক নয়, ইউটিউবে কোনো ভিডিও দেখতে গেলেই হুট করে হাজির হচ্ছে জুয়ার বিজ্ঞাপন।
এসব বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশী সংবাদ পাঠিকা, ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যক্তিত্ব, পাকিস্তানি মডেল ও ইনফ্লুয়েঞ্জার, বাংলাদেশের খ্যাতনামা ক্রিকেটারসহ আরও অনেক সেলিব্রেটির ছবি ও এআই ভিডিও তৈরি করে জুয়ার প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। এইআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো ওইসব ভিডিওতে একজন খ্যাতনামা ক্রিকেটারকে বলতে শোনা যায়, তিনি বেটিং করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। নতুন জুয়াড়ি হিসেবে নাম লেখালেই ৪২ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ওয়েসবাইটগুলোতে জুয়ার বিজ্ঞাপন চলে আসছে।
গেমিং, স্পোর্টস ও গ্যাম্বলিং বিষয়ক ওয়েবসাইট পেটুডের মতে, অনলাইন ক্যাসিনোতে কোনো খেলোয়াড়কে নিয়ে আসতে পারলে অ্যাফিলিয়েট বা প্রচারকরা প্রতি খেলোয়াড়ের জন্য ৫০ থেকে ৪০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে যে খেলোয়াড়দের নিয়ে আসা হয়, সেসব খেলোয়াড়দের ব্যয় করা অর্থের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকেন এই অ্যাফিলিয়েটরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো বাণিজ্যের সুবিধার জন্য মোবাইল ফোনে দিচ্ছে ছোট-বড় প্যাকেজ আকারে ইন্টারনেট সুবিধা, যা সব শ্রেণির মানুষের সাধ্যের মধ্যে। এতসব সুবিধা অনলাইন জুয়াকে সহজতর করেছে। অনলাইন জুয়ায় বড় ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের প্রায় সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত।
ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে টার্গেট করে বিভিন্ন জুয়াভিত্তিক সাইটগুলো প্রতিনিয়ত তাদের লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে। ‘গেম খেলে আয় করুন’-এমন হাজার হাজার টাকার বিজ্ঞাপন বারবার অনলাইনে প্রচার করা হয়। বিনা পরিশ্রমে লাখোপতি হওয়া যাবে, এমন বিজ্ঞাপনের লোভে পড়ে যাচ্ছে যুবসমাজ। অনলাইনে থাকলে অপ্রত্যাশিতভাবে জুয়ার বিজ্ঞাপন সামনে চলে আসছে, বুঝে হোক, না বুঝে হোক বা কৌতূহলী হয়ে সেই বিজ্ঞাপন দেখে প্রবেশ করে জুয়ার আসরে। তরুণরাই তাদের মূল টার্গেট, একবার শুরু হলে আর ফেরার পথ নেই।
জুয়ার বিজ্ঞাপনে অভিনয় করতে দেখা যায় বিভিন্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটরসহ জনপ্রিয় ব্যক্তিদের। অনলাইন জুয়া সাইটে টাকা লেনদেনে সুবিধা অনেক বেশি, বাংলাদেশের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ফলে জুয়া সাইটে টাকা বিনিয়োগ ও উত্তোলন অনেক সহজ। খুব সহজেই লেনদেন সম্পন্ন করা যায়। অনলাইন জুয়ায় বিভিন্ন গেমস, ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ফুটবল বিশ্বকাপসহ নানা বড় ইভেন্ট সামনে এলে জুয়ার কারবার জমজমাট হয়ে ওঠে। দেশের বাইরে থেকে অধিকাংশ সাইটই পরিচালিত হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূলত হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে মেন্টরের অধীনে ভারত, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম থেকে ক্যাসিনো গেম পরিচালিত হয়। এক মেন্টরের অধীনে কয়েক হাজার প্লেয়ার অংশ নেয়। এসব মেন্টর মূলত অংশগ্রহণকারীদের আস্থা সৃষ্টির জন্য লাইভ স্ট্রিমিং গেম পরিচালনা করে থাকে। এ সুযোগে জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। ফলে একদিকে যেমন সর্বস্বান্ত হচ্ছে তরুণ সমাজ, অন্যদিকে টাকা বিদেশে পাচার হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
বিটিআরসি জাতীয় নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত অনলাইন বেটিং সাইট বন্ধ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া সাইট পরিচালনার অনুমোদন নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা কোনো সংস্থা থেকে কোনো সাইট বন্ধের জন্য সুপারিশ করলে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন বন্ধের জন্য গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবকে অনুরোধ করা হচ্ছে। তার পরও অনলাইন জুয়া খেলা বন্ধ হচ্ছে না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে সিআইডি অনলাইন জুয়া বা বেটিং সাইটের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি করছে। সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট শাখার কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, জুয়ার বিভিন্ন সাইটে দেশ থেকে অন্তত ১২ লাখ নিবন্ধন রয়েছে। এরই মধ্যে ৪ থেকে ৫ লাখ আইডিতে নিয়মিত জুয়া খেলা হয়ে থাকে। এসব আইডি থেকে মাসে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।
দেশীয় ডিলারদের কমিশন বাদে বাকি সব টাকাই বিদেশে জুয়ার সাইটের মালিকদের কাছে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বাড়ছে। পাচারে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে গত কয়েক বছরে অন্তত ৫০ হাজার এমএফএস হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানিয়েছেন, অনলাইনের অবারিত দুনিয়ায় জুয়া বা বেটিংয়ের প্রসার রোধে সবার আগে এর প্রচারণা রোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্যোগ জরুরি। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচার এবং জুয়ার ব্যাপক প্রসারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বেসরকারি ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো বিভাগের প্রধান জয়দেব কুমার মৃধা বলেন, এসব জুয়ার সাইট বা গেমিং সাইটে ই-মেইল দিয়ে অ্যাকাউন্ট করতে হয়। খেলার জন্য অর্থ লেনদেনে এমএফএস বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হয়। এতে ওই ক্রেডিট কার্ড ঝুঁকিতে পড়ে। এ ছাড়া এই সাইটগুলো মূলত সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ফিলিপিন্স থেকে চালানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সাইটে লাভবান হওয়া যায় না। টাকাটা বিদেশে চলে যায়। এ ছাড়া এসব সাইটে লগইন করার সময় বিভিন্ন পাসওয়ার্ড হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি প্রবল।
অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, জুয়া আসক্তদের ফেরাতে প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ। জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য কঠোর অবস্থান নিতে হবে সরকারকে। পরিবারে থাকা কম্পিউটার-মোবাইল ফিল্টারিং করতে হবে। বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে হবে, সন্তান কী করছে। আর আসক্তদের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন না করে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক জীবনে। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত শিশুদের মনশ্চিকিৎসা নেওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের এই মানসিক অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে বাবা-ছুটছেন মনশ্চিকিৎসকদের কাছে, অনেকেই সুফলও পাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।