ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

নয়াপল্টনে বিশাল জনসভায় ভিডিও বার্তায় খালেদা জিয়া

প্রতিহিংসা নয়, নতুন সমাজ গড়ি

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৯, ৮ আগস্ট ২০২৪

প্রতিহিংসা নয়, নতুন সমাজ গড়ি

নয়াপল্টনে বিএনপির বিশাল জনসমাবেশ। ইনসেটে খালেদা জিয়া

প্রায় সাড়ে ছয় বছর কারাবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একদিন পর হাসপাতাল থেকে ভিডিওবার্তায় জনসম্মুখে আসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি দলের নেতাকর্মী ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের উদ্দেশে  বলেন, সবাই মিলে আমাদের এখন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণ করতে হবে।

তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শোষণহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হবে। তাই প্রতিহিংসা নয়, আসুন ভালোবাসা দিয়ে নতুন সমাজ গড়ে তুলি। বুধবার বিকেলে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলীয় সমাবেশে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে ভিডিওবার্তায় তিনি এ কথা বলেন।
এদিকে বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।  কেউ দয়া করে প্রতিহিংসায় লিপ্ত হবেন না।
বক্তব্যের শুরুতেই খালেদা জিয়া বলেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে আপনাদের সামনে কথা বলতে পারার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।

আমার কারাবন্দি থাকা অবস্থায় আপনারা আমার কারামুক্তি ও রোগমুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, দোয়া করেছেন। সেজন্য আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে আমরা ‘ফ্যাসিবাদী অবৈধ সরকার’ থেকে মুক্তি পেয়েছি। 
খালেদা জিয়া বলেন, আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের বীর সন্তানদের, যারা মরণপণ সংগ্রাম করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। শতশত শহীদদের জানাই শ্রদ্ধা। এই বিজয় আমাদের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিনের নজিরবিহীন দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে মুক্ত হয়ে এখন আমাদের নির্মাণ করতে হবে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। প্রতিশোধের মানসিকতা না রেখে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়তে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, ছাত্র ও তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তরুণরা যে স্বপ্ন নিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মেধা, যোগ্যতা জ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শোষণহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সকল ধর্র্ম-গোত্রের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শান্তি, প্রগতি আর সাম্যের ভিত্তিতে আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে। আসুন, আমরা তরুণদের হাত শক্তিশালী করি। 
উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে ছয় বছর কারাবন্দি থাকার পর মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তি পান। একই দিনে তিনি তার মেশিন রিডেবল নবায়নকৃত পাসপোর্ট পান। যদিও তিনি বেশ কয়েক বছর আগে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরে আবেদন করেছিলেন। খালেদা জিয়া মুক্তি পেলেও মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শে এখনো এভারকেয়ার হাসপাতালে   চিকিৎসাধীন। 
দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনতে পেরে নয়াপল্টনের সমাবেশে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমস্বরে করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। এ সময় দলের নেতাকর্মীদের পরস্পরের সঙ্গে আলাপকালে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। 
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ॥ এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। যে কোনো সময় তিনি গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় ফিরে যেতে পারেন বলে সূত্র জানায়। 
গত ৮ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কিছুদিন তার শারীরিক অবস্থার কখনো অবনতি, কখনো উন্নতি হয়। তাই তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বাসায়ও নিতে পারেননি স্বজনরা। একপর্যায়ে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে নেতিবাচক গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে তার চিকিৎসক বোর্ডের তৎপরতা জোরদার করা হয়। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। তাই এখন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে সূত্র জানায়।  
৭৯ বছর বয়সী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থারাইটিস ও ডায়াবেটিস ছাড়াও হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, পরিপাকতন্ত্র ও চোখের রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন। এ কারণে ক’দিন পর পর তাকে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। 
২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে বেশ ক’বার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। করোনাক্রান্ত হয়ে ওইবছর ১৫ এপ্রিল এক ঘণ্টার জন্য খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যান করানো হয়। রিপোর্ট ভালো আসায় ওইদিন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি।

২৭ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো না আসায় ওইদিনই তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। ৫৪ দিন পর খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় ১৯ জুন। 
১১৫ দিন পর দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালে ১২ অক্টোবর খালেদা জিয়া আবার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। তার শরীরের একটি অংশের চামড়া ফোসকার মতো (চাকা) হয়েছিল। এ জন্য ২৫ অক্টোবর এভারকেয়ার হাসপাতালে তার বায়োপসি করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ২৭ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় ফিরেন ওইবছর ৭ নবেম্বর।

এরপর ১৩ নবেম্বর আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৮১ দিন চিকিৎসা নেন তিনি। তখন হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তিনি সিসিইউতে ছিলেন। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি তাকে সিসিইউ থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। ৮১ দিন হাসপাতালে থাকার পর ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গুলশানের বাসায় ফিরেন খালেদা জিয়া। 

২০২২ সালের ৬ এপ্রিল এভারকেয়ার  হাসপাতালে গিয়ে রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা, ইমেজিং, ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট, লিভার ফাংশন টেস্ট, কিডনি ফাংশন টেস্ট, হার্টের টেস্টসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করান খালেদা জিয়া। এরপর ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা চিকিৎসা ব্যবস্থায় সামান্য পরিবর্তন আনেন। ১০ জুন রাত সোয়া ৩টায় বুকের ব্যথা নিয়ে চতুর্থ দফায় এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

১১ জুন এনজিওগ্রামের পর তার হার্টে ৩টি ব্লক ধরা পড়লে  ওইদিনই একটি ব্লকে রিং পরানো হয়। পরদিন দ্রুত এনজিওগ্রাম করে তার হৃৎপি-ে তিনটি ব্লক পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ব্লকে রিং পরানো হয়। রিং পরানোর ক’দিন পর তাকে কেবিনে নেওয়া হয়। কেবিনে রেখেই নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা চালায় মেডিক্যাল বোর্ড। এভারকেয়ার হাসপাতালে টানা ১৪ দিন চিকিৎসা শেষে ২৪ জুন গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

এরপর ২২ আগস্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে পরীক্ষা শেষে রাতেই আবার বাসায় ফেরেন তিনি। এর পাঁচদিন পর ২৭ আগস্ট আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর ৩১ আগস্ট তিনি বাসায় ফেরেন। 
২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার পর তিনি গুলশানের বাসায় ফিরে যান খালেদা জিয়া। ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আবার এভারকেয়ার হাসপাতালে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসা বোর্ডের পরামর্শে ওইদিন রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছয়দিন চিকিৎসার পর ৪ মে আবার তিনি গুলশানের বাসায় চলে যান। এরপর আবারও ১৩ জুন তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৫ দিন চিকিৎসা শেষে ১৭ জুন বাসায় ফিরেন। ৫৩ দিন পর ৯ আগস্ট আবারও চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রয়োজনীয় শারীরিক পরক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওইদিনই হাসপাতালে ভর্তি হন।  ৫ মাস ২ দিন পর এ বছর ১১ জানুয়ারি তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেন। 
এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেদিনই তিনি গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফিরেন। এর পর ১৩ মার্চ এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একদিন পর ১৪ মার্চ তিনি বাসায় ফিরেন। ৩০ মার্চ দিবাগত রাত ৩টায়  আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা শেষে ২ এপ্রিল বাসায় ফিরেন তিনি। এর পর ১ মে সন্ধ্যায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ২ মে রাতে তিনি বাসায় ফিরেন। 
২১ জুন গভীর রাতে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১১ দিন চিকিৎসা শেষে ২ জুলাই সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেন খালেদা জিয়া। ২৩ জুন তার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়। সর্বশেষ ৮ জুলাই খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেও চিকিৎসকদের পরামর্শে এখনো তিনি হাসপাতালে অবস্থান করছেন।

এদিকে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, কেউ দয়া করে প্রতিহিংসায় লিপ্ত হবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। বুধবার বিকেলে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত বিশাল দলীয় সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দেওয়া প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এ কথা বলেন। 
তারেক রহমান বলেন, দেশের চলমান অর্জনকে নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র চলছে। ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সকলকে নিরাপত্তা দিতে হবে। যে যেখানে বসবাস করছেন সেখানে ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দেশের ভূখ-ে দাঁড়িয়ে সকল জনগণের পরিচয় একটি সবাই আমরা বাংলাদেশী। নৈরাজ্য কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। 
তারেক রহমান বলেন, বিএনপির নামে যদি কেউ অপকর্ম করতে চায় তাকে আইনের হাতে তুলে দিন। কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে তার বিরুদ্ধেও পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিল করুন। বিচারের ভার দয়া করে কেউ নিজ হাতে তুলে নেবেন না। তিনি বলেন, প্রশাসনকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।

জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে মেধার অগ্রাধিকার থাকতে হবে। তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ স্বাধীনতার রক্ষায় কোনো শর্ত মানে না। ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে ২০২৪ সালে দেশের জনগণ দেখেছে এক নতুন স্বাধীনতা। ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এই বার্তা দিয়েছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো শর্ত মানে না। দেশের অনেক মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি।

প্রতিটি মানুষের অনুভূতি ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে’। ছাত্র-জনতাসহ গণতন্ত্রকামী সব মানুষ রাজপথে শামিল হয়েছিল। তাই ৫২, ৭১ ও ৯০’র মতো ছাত্রসমাজ বিজয়ের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাই ছাত্র-জনতাসহ সবাইকে অভিনন্দন জানাই। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাই কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে।

বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় দল তাই বিএনপিকে সকল ধর্ম ও বর্ণের জনগণের নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নৈরাজ্য কোনো সমাধান হতে পারে না। তাই বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ নৈরাজ্য করলে তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।  
তারেক রহমান বলেন, দেশের প্রত্যেকটি মানুষের পরিচয় আমরা বাংলাদেশী। পুলিশ জনগণের শত্রু নয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে পুলিশকে ব্যবহার করেছেন। আমরা জানি ভেতরে একটি চক্র ছাড়া অধিকাংশ পুলিশ সদস্য চাকরিবিধি মেনে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের মনোবল ভাঙতে একটা চক্র কাজ করছে।

তিনি বলেন, বিনা ভোটে নির্বাচিত শেখ হাসিনার সরকার পুলিশকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য করে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এখন পুলিশের মনোবল ভেঙে তাদের অকার্যকর করে একটি চক্র দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই। 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হিংসা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা নয়, দায়িত্বশীলতা ও মানবাধিকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপরাধ করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করুন।
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করা ছাত্র-জনতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ছাত্র জনতার আন্দোলনে গণতন্ত্র হত্যাকারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ পরাজিত হতে পারে না। কোনো অপশক্তি বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখতে পারবে না।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে যত মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, সবাই বলেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে সাঈদ-মুগ্ধসহ অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। শিক্ষার্থী-সাধারণ মানুষ-রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা প্রাণ দিয়েছেন। তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 
তারেক রহমান বলেন, দেশে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি প্রণয়ন করে উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতিতে গুণগত মান ফিরিয়ে আনতে হবে। একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। 
দেশবাসীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আর প্রতিহিংসা নয়, আসুন সবাই মিলে দেশে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করি। সবার জন্য দুর্নীতিমুক্ত ও নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামী দিনে দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব। সবাই যার যার এলাকার জনগণের পাশে থাকবেন। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। 
তারেক রহমান বলেন, নিয়োগ বা প্রমোশনে মেধার সর্বাধিক অগ্রাধিকার থাকতে হবে। উন্নয়নে বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার সমস্যা সমাধান করতে হবে। সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। 
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, শেখ হাসিনার দালালদের কাউকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে নেওয়া যাবে না। আর দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা স্থানান্তর করতে হবে। সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশের তরুণদের জন্য একটি নিরাপদ দেশ গড়ে তুলতে পারব আমরা।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ভূখ-ে যে যে ধর্মে বিশ্বাস করুন, তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সবাই তাদের নিরাপত্তার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন। নৈরাজ্য কোনো সমাধান হতে পারে না। আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, পুরো দেশ ১৫ বছর ধরে কারারুদ্ধ ছিল। এখন দেশ মুক্ত হয়েছে। প্রিয় বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। ছাত্র-জনতা ও দলের নেতাকর্মীসহ সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আজ প্রমাণিত হয়েছে ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে অগণতান্ত্রিক শক্তি পরাজিত হতে বাদ্য।  
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। যারা এগুলো করছে তারা বিএনপির কেউ না, তারা দেশের শত্রু। 
সরকার পতনের আন্দোলনে যুক্ত ছাত্র-জনতা ও নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফখরুল বলেন, অনেক রক্ত, অনেক জীবনের বিনিময়ে দেশে এই অবস্থা পেয়েছি। আমাদের বহু ছেলেরা ১৬ বছর বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি, অনেকে গুম হয়েছে, খুন হয়েছে। আমাদের অনেকের সন্তানরা তাদের বাবাদের দেখতে পারেননি।
সবাইকে নাশকতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে ফখরুল বলেন, যারা গার্মেন্ট শিল্পের ওপর আক্রমণ করছে, তারা দেশের শত্রু। এসব কোনো আন্দোলনকারীদের কাজ হতে পারে না। তিনি বলেন, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এসবে কেউ জড়িত হবেন না। আমরা জানি আমাদের নেতাকর্মীরা এসব কাজে যুক্ত না। যারা এসব করছে তারা দেশের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফখরুল বলেন, স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। আর যেন তিনি দেশে ফিরে আসতে না পারেন। ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যারা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং ছাত্রজনতার আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বিএনপির দেয়া ৩১ দফা অনুসারে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠন করতে হবে। 
অনতিবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার আহ্বান জানিয়ে ফখরুল বলেন, এ সরকার ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। আমরা তাদের পূর্ণ সহযোগিতা করব। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে আমরা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। প্রতিহিংসা নয় আমরা ছাত্র আন্দোলনের বিজয়কে ধরে রাখতে চাই।

তাই সবাই সাবধান থাকবেন, যেন আমাদের অর্জিত বিজয় কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে। তিনি বলেন, যারা ভাঙচুর, লুট ও অগ্নিসংযোগ করে তারা দুর্বৃত্ত, তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়।  
বেলা ২টা ৪০ মিনিটে কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে বিএনপির সমাবেশ শুরু হয়। এর অনেক আগেই নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয়  কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে যোগ দিতে নেতাকর্মীদের ঢল নামে। তারা রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা থেকে দলে দলে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহন করে নানা স্লোগান দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও বিএনপি নেতাকর্মীরা সমাবেশে আসে। এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে পল্টনের আশপাশের বিভিন্ন সড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। 
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান প্রমুখ।

×