
দামের নিশ্চয়তা পেলে আগামীতে আরো বেশি কৃষক জমিতে পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন এবং দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়বে।
এবার ভালো দাম পেয়ে উচ্ছ¡সিত দেশের পেঁয়াজ চাষিরা। এতে আগ্রহ বেড়েছে অন্য চাষিদের মধ্যেও। দামের নিশ্চয়তা পেলে আগামীতে আরো বেশি কৃষক জমিতে পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন এবং দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়বে। সম্প্রতি সরেজমিনে পাবনা ও নাটোরের কৃষকদের সাথে আলাপচারিতায় তারা এ কথা জানিয়েছেন।
কৃষিবিদরা বলেছেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলে পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা যাবে। আমদানির প্রয়োজন না হলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে না। কারণ, আমদানীকৃত পেঁয়াজের দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাজারে দেশীয় পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে।
পেঁয়াজ চাষি, ব্যাপারী, আড়তদার এবং আমদানিকারকদের মতে, পচনশীল এ পণ্যটির ওজনও অন্যান্য কৃষি পণ্যের তুলনায় দ্রুত কমতে থাকে। সে কারণে কেউ মজুদ করতে চাইলেও লাভের চেয়ে লোকসানের ঝুঁকি বেশি। ফলে কৃষক ছাড়াও হাজার হাজার ব্যবসায়ী এবং শত শত আমদানীকারক সম্পৃক্ত এ পণ্যে সিন্ডিকেট করে দর নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
দেশে সব চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলাগুলোর চাষিদের তথ্যানুযায়ী, মৌসুমের প্রথম পর্যায়ে ডিসেম্বরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে মার্চে হালি পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয়। শুরুতে সরবরাহ বেশি হওয়ায় বিক্রিও হয় কম দামে। এর দু’এক মাস পর থেকে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
সংরক্ষিত পেঁয়াজের ওজন কমে যায় এবং তা সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বেড়ে যায় বলেও জানিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।মাঠ পর্যায়ে আলাপকালে জানা যায়, পাবনার সুজানগরের ঘুশ্যামপুর গ্রামের কৃষক মোঃ হাফিজুল ইসলাম গত মৌসুমে এক একর জমিতে আবাদ করে দেড়শ’ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন করেছেন। ৪০ কেজির প্রতিমণ পেঁয়াজ গত মার্চ মাসের শুরুতে ১৫শ” থেকে ১৬শ’ টাকা দরে বিক্রি করলেও জুন শেষে বিক্রি করেছেন ৩৫শ’ টাকা মন দরে। তিনি জানান, “মৌসুমের শুরুতে সরবরাহ বেশি থাকায় ভালো দাম পাওয়া যায় না বলে আমরা (চাষিরা) অল্প পেঁয়াজ বিক্রি করে অধিকাংশ নিজেদের বাড়িতে সংরক্ষণ করি। আবার যখন সরবরাহ কমে চাহিদা বাড়ে তখন ভালো দামে বিক্রি করি।”
পচে যাওয়া এবং ওজন কমে যাওয়ার কারণে পেঁয়াজ দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না উল্লেখ করে পেশাদার চাষি হাফিজুল ইসলাম জানান, “প্রতি ৪০ কেজি সংরক্ষণ করা পেয়াজের ১০ কেজির বেশি কমে যায়। ওই ১০ কেজির ক্ষতি বাকী ৩০ কেজিতে সমন্বয় করে আমরা যে দামে বিক্রি করি তখন সে দরকে কোনো কোনো মহল অযৌক্তিক বা অন্যায় বলে মন্তব্য করে থাকেন।”
পেঁয়াজের সরবরাহ ও বাজারদর নিয়ে আলোচনাকালে পাবনার বনগ্রাম, বেড়া ও কাশিনাথপুর এবং নাটোরের তাহেরপুর হাট, বিশট হাট ও মালোঞ্চি বাজারের স্থানীয় ব্যাপারীরা (কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের পাইকারদের কাছে সরবরাহকারী) জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত পেঁয়াজের পাশপাশি আমদানির মাধ্যমে বাজার চাহিদা মেটানো হয়। অর্থাৎ বহুমুখী সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে এ ব্যবসায় কোনো এক পক্ষ বা গোষ্ঠীর দ্বারা দাম হেরফের করার সুযোগ নেই।
তিন দশক ধরে নিজ এলাকাসহ কাশিনাথপুর ও বনগ্রামের হাটে কৃষকদের কাছ থেকে কিনে গড়ে মাসে ৮০ টন পেঁয়াজ ঢাকায় সরবরাহ করেন তোফাজ্জল। তিনি জানান, “চাষিরা তাদের পারিবারিক চাহিদা মেটাতে মৌসুমের শুরুতে কিছু পেঁয়াজ বিক্রি করে বাকি সব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন, যা পর্যায়ক্রমে বিক্রি করেন।”
নাটোরের কৃষকদের মতে, পার্শ্ববর্তী জেলা পাবনার তুলনায় তাদের এলাকায় সমপরিমাণ জমিতে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ বিঘাপ্রতি ১২০ মণ পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। তাদের একজন জেলার সদর থানা এলাকার কৃষক আশরাফুল প্রামাণিক। তিনি জানান, “পচনশীল বিধায় ধান-গম বা আলুর মতো পেঁয়াজ দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। ছয় মাস সংরক্ষিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ শতাংশ ওজন কমে যাওয়ায় ওই পেঁয়াজ ১০০ টাকা দরে বিক্রি করলেও মূলতঃ প্রতি কেজি ৬০ টাকায় নেমে যায়।”
এ জেলার নলডাঙ্গাস্থ মোল্লাপাড়ার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নেকবর স্থানীয় বাজারে কৃষকদের কাছ থেকে সংগৃহীত পেঁয়াজ ঢাকাসহ দেশের আরো কয়েকটি জেলার পাইকারদের কাছে সরবরাহ করেন। তিনি জানান, “ভারতে উৎপাদন এবং দেশটির নির্ধারিত রপ্তানী মূল্য কখনো কখনো বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার দরে প্রভাব ফেলে।” স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বর্তমান পর্যায়ে থাকলে দেশের কৃষকরা আরো বেশি পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত হবেন বলে মনে করেন তিনি ।
ভালো ফলনে কৃষকদের জৈব সার সরবরাহে সম্পৃক্ত বিশিষ্ট কৃষিবিদ আবু তাহেরের মতে, “বর্ষা মৌসুমে পেঁয়াজ চাষ করা যায় না। ফলে জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সাধারণত পেঁয়াজ আমদানি করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বাজারে আমদানি করা পেয়াজের অধিক্য থাকে। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দরের উপর ভিত্তি করে বাজার দর নির্ধারণ হয়।”
দেশীয় মজুদ পেঁয়াজের দরও আমদানি করা পেঁয়াজের দরের কাছাকাছি থাকে উল্লেখ করে এই কৃষিবিদ জানান, ২০২৩ সালে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় স্থানীয় বাজারে তার প্রভাব পড়ে এবং অস্বাভাবিক হারে দাম বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে পেঁয়াজের উৎপাদন পরিসংখ্যানে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। এতে করে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ফলে বাজার সরবরাহ ঠিক রাখতে ভারত, চীন ও নেদারল্যান্ডস থেকে প্রায় ২শ’ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যার বেশির ভাগই আনা হয়েছে ভারত থেকে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের অন্যমত পেঁয়াজ আমদানিকারক মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছর পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এ বিষয়টি আমলে না নিয়ে মহল বিশেষ কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই পেঁয়াজের দর বৃদ্ধির জন্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মজুতদারি ও দর কারসাজির অভিযোগ তুলেছে। তার মতে, বহু ধাপ ও অগণিত ব্যবসায়ী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এ ব্যবসায় মূল্য কারসাজি বা সিন্ডিকেটের অভিযোগ অমূলক ও অযৌক্তিক।
টুম্পা