ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কমছে জমির উৎপাদন ক্ষমতা

খুলনার মাটি ও পানিতে অস্বাভাবিক মাত্রায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি

প্রবীর বিশ্বাস, খুলনা অফিস

প্রকাশিত: ২২:১৩, ২৮ জুন ২০২৪

খুলনার মাটি ও পানিতে অস্বাভাবিক মাত্রায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি

.

প্রতিবছরই ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে উপকূলীয় অঞ্চলের নদ-নদী ও খালগুলোর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ। এতে করে দিন দিন ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে জলাধারের পানি। শুধু জলাধারই নয় লবণাক্ততা বাড়ছে কৃষি জমিতেও। গত কয়েক বছরে এতটাই বেড়েছে যে জমির ফসল উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে একই সঙ্গে মানুষের চর্মরোগ ও নারী-শিশুদের নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উজান থেকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নোনা পানির আধিক্য বাড়ছে। 
খুলনা বটিয়াঘাটার লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের (মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট) সর্বশেষ জরিপে জানা যায়, গত এপ্রিলে কয়রা খালের পানিতে অস্বাভাবিক লবণাক্ততা ৪২ দশমিক নয় ডেসিসিমেন (ডিএস) মিটার পাওয়া যায়। সাধারণত ৫-এর ওপরে গেলে পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যায় না। আর সমুদ্রের পানিতে লবণাক্ততা ৫০ এর কাছাকাছি। একই সময় রূপসা নদীতে লবণাক্ততা ছিল ২৩ দশমিক সাত ডিএস মিটার। যা ২০২৩ সালের মে মাসে ছিল ১৮ দশমিক ৫৬। পাইকগাছা শিবসা নদীতে এপ্রিলে লবণাক্ততা ছিল ৩৫ দশমিক নয় ডিএস মিটার। যা আগের বছরের মে মাসে ছিল ২৬ দশমিক ৬৪। এ ছাড়া পশুর নদী মোংলায় ৩৩ দশমিক তিন ও দড়াটানা নদী বাগেরহাট লবণাক্ততা ২২ দশমিক আট ডিএস মিটার। একইভাবে গত মার্চে ডুমুরিয়ার গুটুদিয়ায় মাটিতে লবণাক্ততা ছিল চার দশমিক ছয়, ফুলতলা ও বটিয়াঘাটায় চার দশমিক এক, দাকোপ উপজেলার বাজুয়াতে নয় দশমিক এক এবং পাইকগাছার শিববাড়ি এলাকার মাটিতে ১৪ ডিএস মিটার। 
আরও জানা যায়, গত ৫০ বছরে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬ দশমিক সাত ভাগ। ২০২২ সালে সর্বশেষ দেশের উপকূলীয় ১৮টি জেলায় জরিপ চালানো হয়। এতে প্রাথমিকভাবে ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ১১ লাখ হেক্টর। এর আগে ২০০০ সালের জরিপে উপকূলের লবণাক্ত জমি ছিল ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ হেক্টর ও ২০০৯ সালের জরিপে ছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। 
লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, আমরা প্রতি মাসে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার নয়টি উপজেলার ১৭টি পয়েন্ট থেকে মাটি ও ১৩টি নদীর পানিতে লবণাক্ততা পরীক্ষা করি। লবণাক্ততার সহনশীলমাত্রা প্রতি মিটারে পানির জন্য ০.৭৫ ডিএস ও মাটির জন্য দুই ডিএস। মাটিতে লবণক্ততা চার ডিএস মিটারের বেশি থাকলে ফলন কমে, চার থেকে আট ডিএস মিটার পর্যন্ত লবণ থাকলে ফলন আরও কমে যায়। চলতি মৌসুম অতিরিক্ত খরা ও লবণাক্ততার কারণে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার সবজি চাষ ব্যাহত হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা কারণে পনিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ইতোমধ্যে আমাদের অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় মানুষ পেশা পরিবর্তন করছে, এমনকি বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। লবণের পরিমাণ এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে গবেষণা করে লবণসহিষ্ণু ধানের জাত তৈরি করলেও দুই তিন বছর পর লবণাক্ততা আরও বেড়ে যাওয়ায় সেই জাত আর কাজে আসছে না। এ ছাড়া মানুষের চর্মরোগসহ নানা রোগ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের বয়োঃসন্ধিকালীন জটিলতাসহ প্রজননে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া শিশুরাও নতুন নতুন রোগে সংক্রমিত হচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) খুলনার বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘উপকূল অঞ্চলের প্রায় ২০০ কিলোমিটার ভেতরে লবণাক্ততা চলে আসছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল থেকে অভ্যন্তরীণ ভূখন্ডের দিকে লবণাক্ত পানি প্রবাহের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে নোনা পানিতে চিংড়ি চাষ, নদী ভরাট হওয়া ও বেড়িবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের নোনা পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে। তাই লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে নদীর পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন নদী খনন। এ ছাড়া পোল্ডারগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে এবং নদীর পানি প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
 

×