একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান পেল যে মাসে তার নাম মার্চ। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ। কয়েক শতাব্দীর ঔপবিনেশিক দুঃশাসনের পাথার পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ‘পাকিস্তান’ নামে বাঙালির ভাগ্যে যা জোটে, তা ভিন্নরূপে আরেক অপশাসন, নির্যাতন আর বঞ্চনা ছাড়া কিছুই নয়। বাঙালি জাতি ওই শোষণ-বঞ্চণার হাত থেকে মুক্তি পেতে নেমে পড়ে রাজপথে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সীমাহীন দেশপ্রেম, তুলনাহীন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অসীম সাহস, দূরদর্শিতা আর দৃঢ় নেতৃত্বে এই পলল ভূখ- একাত্তরের মার্চে এসে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
রক্তক্ষরা-অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিন আজ। উনিশশ’ একাত্তর সালের এই মাসে তীব্র আন্দোলনের পরিণতিতে শুরু হয় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলেও চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই।
বছর ঘুরে এবার সত্যিই এক মাহেন্দ্রক্ষণে বাঙালির জীবনে এসেছে অগ্নিঝরা মার্চ। এবারের অগ্নিঝরা মার্চ মাস বিশেষ তাৎপর্য বয়ে এনেছে পুরো জাতির জীবনে। কেননা মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় রয়েছে।
পহেলা মার্চ, ১৯৭১। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে রাজপথে। ততক্ষণে হাজারো মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে দেয়। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
সেদিন মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মতো সেøাগান দেয়, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানায়। বিক্ষোভ-সেøাগানে উত্তাল ঢাকাসহ সারাদেশ। আর কোনো আলোচনা নয়, এবার পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি ক্রমশ বেগবান হতে থাকে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাইরে চলছে বিক্ষুব্ধ বাঙালির কঠোর কর্মসূচির দাবিতে মুহুর্মুহু সেøাগান। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন।
সেই শুরু। এরপর ১ মার্চ পেরিয়ে ২ মার্চ। একে একে পার হয় ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ২৫টি দিন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। এই পথ ধরে বাঙালি দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে একটি স্বাধীন দেশÑ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
বছর ঘুরে এক অন্যরকম পরিবেশে বাঙালির জীবনে এসেছে অগ্নিঝরা মার্চ। একাত্তরের পরাজিত শত্রু ও তাদের দোসররা এখন অনেকটাই গর্তে ঢুকে পড়েছে। দেশ-বিদেশে নানা মিথ্যাচার, প্রপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিলেও দেশের কোথাও প্রকাশ্য মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই তাদের।
তবে পরাজিত শত্রুদেশ পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান।
আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং আলোর মিছিল করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠন অগ্নিঝরা মার্চ স্মরণে মাসব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মাসব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং বীর শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।