ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সর্বত্র পলিথিন-প্লাস্টিক

​​​​​​​ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ০০:১০, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সর্বত্র পলিথিন-প্লাস্টিক

.

হাট-বাজার থেকে শুরু করে কাঁচা বাজার, পান-চুনওয়ালা থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, তরিতরকারি, বিপণি বিতান থেকে শুরু করে অভিজাত শপিংমলে সব ভোগ্যপণ্য নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন দোকানিরা। আবার আমরা প্লাস্টিকের বোতল, থালা, চামচ ইত্যাদি হরদম ব্যবহার করছি। আর এসব পলিথিন প্লাস্টিক বাসাবাড়ি বা অফিস ঘুরে আবার রাস্তায়, নালা-নর্দমায়, কৃষি জমিতে, নদীতে পতিত হচ্ছে। দেশের সর্বত্রই যেন পলিথিন প্লাস্টিক। এতে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, উৎপাদন প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অথচ পলিথিন রিসাইক্লিং (পুনর্ব্যবহার) করা সম্ভব। কিংবা রিসাইক্লিং করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করাও সম্ভব। কিন্তু দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রিসাইক্লিংয়ের ওপরে কোনো জোর নেই। ছোট-বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে রিসাইক্লিং করলেও এর সংখ্যাও খুবই কম। ব্যক্তি পর্যায়ে যারা রিসাইক্লিং করে থাকেন, পৃষ্ঠপোষকতা স্বীকৃতি না থাকায় তাদের মধ্যেও রয়েছে অনীহা। এতে যত্রতত্র প্লাস্টিক পলিথিনে পরিবেশ দূষিত হয়েই যাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং দূষণ রোধে কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় দূষণের পথ যেমন সুগম হচ্ছে, তেমনি দিন দিন মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।

পরিবেশ কৃষিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধ পণ্য। আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একটি নিষিদ্ধ জিনিসের ব্যবস্থাপনা না করে এর উৎপাদন এবং ব্যবহার একেবারেই বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে তারা। তবে যারা রিসাইক্লিং করে থাকেন, তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি পুরস্কৃত করতে হবে। পাটজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে পাটকলের সরকারিকরণ পাট চাষে সরকারি অনুদান বৃদ্ধি করাও জরুরি। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই দূষণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। 

প্রসঙ্গে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের ১২ জেলার ৪০টি উপজেলায় সিঙ্গেল ইউজ (একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়) প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রণয়ন করা হয়েছে। সমুদ্র সৈকত তৎসংলগ্ন হোটেল-মোটেলে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বিভিন্ন আইটেম পর্যায়ক্রমে বন্ধের  কার্যক্রম চলছে।

পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলছেন, ‘একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বলতে আইনগতভাবে কী বোঝায় সে সংজ্ঞাটা আমরা তৈরি করেছি। ছাড়া পণ্যগুলো চিহ্নিত করেছি কোন কোন পণ্য একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। এখন আমরা এসবের উৎপাদন বিতরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

অনুসন্ধান করে জানা যায়, ২০০২ সালের মার্চে সারাদেশে পলিথিন উৎপাদন বাজারজাত বন্ধ করতে আইন জারি করা হয়। এও বলা হয়, বিকল্প হিসেবে যেন সবাই পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। আশ্চর্যের দিক হলো, একই বছরের জুনে দেশের সেরা পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। এরপর থেকে সরকারি পাটকলগুলোর বেসরকারিকরণ অব্যাহত থাকে। পাট চাষে সরকারি প্রণোদনা কমে যায়, পাট হয়ে যায় দুর্লভ বস্তু। আর ২২ বছর আগে উৎপাদন এবং বাজারজাতে নিষিদ্ধ করা পলিথিনের ব্যবহার এখনো দেদার চলছে। অপরিকল্পিতভাবে পলিথিন-প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান বিশ্বে দশম। নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য, অভিযান চালাতে গেলে ফ্যাক্টরিতে কাউকে পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে অভিযানে জব্দ করা পলিথিন চট্টগ্রামে অনুমোদিত রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানের কাছে নিলামে বিক্রি করা হয়। 

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, সারাদেশে পলিথিন উৎপাদন এবং ব্যবহার হয়ে আসলেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে শুধুমাত্র কয়েকটি জায়গায় রিসাইক্লিং করা হয়। এর মধ্যে গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে রিসাইক্লিং করা হয়। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই বেশ কিছু জায়গায় ব্যক্তি পর্যায়ে রিসাইক্লিং করা হয়।

সংস্থার তথ্যমতে, গাজীপুরে গার্মেন্টসসহ ছোট-বড় প্রায় সাড়ে হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান ড্রাই ওয়াশ রঙের কাজ করে। এসব ড্রাই ওয়াশ রং আশপাশের নদীতে প্রতিনিয়ত পতিত হচ্ছে। অথচ এসব এলাকার বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য রিসাইক্লিং করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র -১০টির মতো। নামি-দামি কোনো কোম্পানিও রিসাইক্লিং করে না। যারা করে থাকে, তারা প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেটে কেটে বদনা, বালতি বানিয়ে থাকে। এতে পরিবেশের কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা হলেও সেগুলো পরিবেশবান্ধব উপায়ে রিসাইক্লিং করা হয় না। কেননা, ছাড়পত্র নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ময়লা-আবর্জনা, ধুলা-বালিযুক্ত পলিথিন-প্লাস্টিকের পণ্য সংরক্ষণ করে। পরে তা কেটে, ধুয়ে পরিষ্কার করতে গেলে পরিবেশ দূষিত হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গাজীপুরের আশপাশের নদীতে প্রতিদিন প্রায় ৯১০ মিলিয়ন টন মানুষের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য পতিত হয়। এই এলাকায় এত কারখানা সত্ত্বেও ডাম্পিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। যারা রিসাইক্লিং করেন, তারা স্তূপ থেকে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পলিথিন-প্লাস্টিক সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং করেন। এই প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল। কারণে অনেকে করতে চান না।

তিনি বলেন, ‘ময়লার স্তুপ থেকে পলিথিন, প্লাস্টিক পণ্য আলাদা করা সিটি করপোরেশনের পক্ষেও কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে বাসা-বাড়িতে ময়লা ফেলার পাত্র আলাদা থাকা দরকার। কেউ বাজার থেকে পলিথিনে করে মাছ কিনে নিলে পলিথিনটা ধুয়ে বারান্দার আলাদা পাত্রে রাখতে পারেন। তখন এসব পণ্য সিটি করপোরেশন আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারে। এই কাজটা মূলত সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের।’   

তবে বিক্রেতারা পলিথিন ব্যবহারের জন্য এর উৎপাদন এবং ক্রেতাদেরই দায়ী করেন। আর গ্রাহকরাও পলিথিনের কু-প্রভাবের কথা জেনেও তা গ্রহণ করতে কখনো অস্বীকার করছে না। নিষিদ্ধ থাকলেও কেন ব্যবহার হচ্ছে, এমন প্রশ্নে একাধিক দোকানি জানান, অধিকাংশ ক্রেতা ব্যাগ নিয়ে আসেন না। কাগজ বা পাটের ব্যাগ ক্রেতারা বেশি দামে কিনেন না বলে পলিথিন দিতে হয়। কোন কোন দোকানি বলছেন, পাট বা অন্য ব্যাগের দাম বেশি। বিনা খরচে তাই পলিথিন ব্যবহার করেন তারা।

তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধ পণ্য। পরিবেশ, স্বাস্থ্য, উৎপাদন প্রকৃতির জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বছরের পর বছর এর ব্যবহার চলছে, উৎপাদন করা হচ্ছে। একটা নিষিদ্ধ জিনিসের ব্যবস্থাপনা কেন করা হবে। তার মতে, এসব ব্যবস্থাপনা কিংবা পুনর্ব্যবহারের নামে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। তাই পলিথিন একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা সব সময় ব্যবসায়িক দিকটা দেখে থাকেন। তারা শুধু লাভ খোঁজেন। পরিবেশের কি হলো সেটি দেখার বিষয় নয়। পলিথিন-প্লাস্টিকের বর্জ্য রিসাইক্লিং করতে গিয়ে যদি খরচ বেশি হয়, তা হলে নিশ্চয় ব্যবসায়ীরা সেটি করবেন না। সরকারও কোনো অনুদান দিচ্ছে না। তাই ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে উদাসীন। কিছু এনজিও ব্যক্তি পর্যায়ে রিসাইক্লিং করা হলেও সেটিও খুবই কম। পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি, সরকার সেদিকে যায়নি। উল্টো সরকার পাট শিল্পকে নষ্ট করেছে এবং পলিথিনের ব্যবহার এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এখন পলিথিন ছাড়া আমরা চলতেই পারি না। অনেকেই বলে থাকেন- পলিথিন-প্লাস্টিকের সঙ্গে শ্রমিক জড়িত, কর্মসংস্থানের বিষয় রয়েছে। যদি হিসাব করা হয়- কতগুলো প্রতিষ্ঠান পলিথিন উৎপাদন করছে এবং এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা কত। তা হলে দেখা যাবে উৎপাদন এবং শ্রমিকদের পেছনে যে অর্থ খরচ হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি আমাদের অন্যভাবে ক্ষতি হচ্ছে। তাই অচিরেই পলিথিন উৎপাদন ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া উচিত এবং বিকল্প ব্যবস্থা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

শুধু তাই নয়; এই পলিথিনের অপব্যবহার সঠিক পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং না হয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতিতে রিসাইক্লিংয়ের ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং দেশের অন্য বড় শহরগুলোতে পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে মন্ড তৈরি করে এর দ্বারা জর্দার কৌটা অন্যান্য প্যাকেজ উপজাত তৈরি করছে। এর ফলে পলিথিন পোড়ানো বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশ জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলছে। এই বিষাক্ত ধোঁয়ায় নানা ধরনের চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, যা হাঁপানির মতো মারাত্মক রোগে প্রতিনিয়তই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ জাতীয় সংসদে এক জরুরি জনগুত্বসম্পন্ন নোটিসে ঢাকা শহরকে রক্ষায় পরিবেশ ধ্বংসকারী একবার ব্যবহারযোগ্য (সিঙ্গেল ইউজ) প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বন্ধের দাবি করছেন। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে রাজধানীর পরিবেশ রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ দাঁড়াবে জানিয়ে ফেরদৌস বলেন, ‘প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রতিদিন অতিমাত্রায় প্লাস্টিকনির্ভর হয়ে পড়ছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, উৎসবে, পিকনিকে ওয়ান টাইম গ্লাস, চায়ের কাপ, প্লেট, চামচ, প্যাকেট ইত্যাদি ব্যবহারের পর আমরা যত্রতত্র ফেলে দেই।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারসহ অনেক বিজ্ঞাপন প্রচারণার জন্য এখন প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার লিফলেটের ব্যবহার রেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুণ। প্রয়োজন শেষে ফেলে দেওয়া এসব প্লাস্টিক বছরের পর বছর মাটির নিচে থাকলেও তা পচে না। ধরনেরওয়ান টাইমপ্লাস্টিক বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের উদ্বেগের কারণ।

তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন ফুরালে এসব প্লাস্টিকের শেষ ঠিকানা হয় রাজধানীর ড্রেন নালা-নর্দমা। এতে একদিকে বাড়বে জলাবদ্ধতা, অন্যদিকে দেখা দিচ্ছে পরিবেশের ভয়ংকর ক্ষতি। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে পরিবেশ দূষণের হুমকি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক . এম শহীদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত উৎসাহ, স্বীকৃতি প্রণোদনা না থাকায় পলিথিন-প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে আগ্রহ কম। কোনো কাজ করে যখন রিটার্ন বা প্রতিদান পায় মানুষ, তখন সেই কাজের প্রতি আগ্রহী হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহারের প্রতি জোর দেওয়া হলেও বাংলাদেশে এই কার্যক্রম সীমিত আকারে পরিচালিত হয়। মূলত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলাদেশে বৃহৎ আকারে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার দায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের ওপর বর্তায়। নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী চিন্তাভাবনার কারণে এসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা জরুরি। জাপানের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, জাপানে আলাদা আলাদা বিন বা ডাস্টবিন রাখা হয়। পানি পান করা শেষে খালি বোতল নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলা হয়। পরে এসব বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করে। এসব পণ্য ব্যবহারে আগে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে হবে। বিকল্প দিতে হবে। প্রয়োজনে দুই টাকার কাপড়ের ব্যাগ দিতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় ঠিক করতে হবে। এসব বিষয়ে আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি সবই আছে। তা সত্ত্বেও বাস্তবে বাস্তবায়ন নেই। তবে এসব বর্জ্য পুনরায় ব্যবহারের চেয়ে হ্রাস করাকে প্রাধান্য দেন তিনি।

. এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘পুনরায় ব্যবহার করা হয় বলেই অনেক ধরনের বর্জ্য হ্রাস করা যাচ্ছে না। পলিথিন উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা আইন আছে। আইনে সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে। বিকল্প উপায় না থাকায় সবাই পলিথিন ব্যবহার করছে। এমনকি পরিবেশবিদরাও বাইরে বের হলে তাদের পলিথিন ধরিয়ে দিলে তারা তা গ্রহণ করছেন। কারণ বিকল্প নেই। পলিথিনের বিকল্প করতেই হবে। তবে শুধু সরকারি বা ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমস্যা বিচার না করে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির দিকেও জোর দেন শহীদুল ইসলাম।

যা করা যেতে পারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন। ময়লার জন্য দুটো পাত্রের ব্যবহার করা। একটিতে পচনশীল বর্জ্য রাখতে হবে, অন্যটিতে অপচনশীল বর্জ্য রাখতে হবে এবং অপচনশীল বর্জ্যগুলো নিরাপদ অল্প জায়গায় ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, যাতে এর প্রভাব অন্য কোনো ভূমির ওপর না পড়ে। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি কোনায় ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। তা ছাড়া প্লাস্টিকের বোতল পলিথিন এবং অন্যান্য কাগজ, কাচের বোতলÑ এগুলো বাজারেও নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করা যায়। বিষয়ও সবাইকে জানাতে হবে। এতে ময়লা সংগ্রহকারী বা রকম ভ্রাম্যমাণ জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের উপার্জন আরও বাড়বে। পদ্ধতির মাধ্যমে একদিকে তাদের জীবিকার পথ যেমন নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

সিলেটের মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান পলিথিনের হাট চালু করেছেন। প্রতি রবিবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে মেয়র চত্বরের হাটে লোকজন কুড়িয়ে পাওয়া পলিথিন নিয়ে জড়ো হচ্ছেন। প্রতি কেজি পলিথিনের বিপরীতে পাচ্ছেন ৫০ টাকা। এই পলিথিন আপাতত পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনে জমা রাখা হয়। পরে পরিত্যক্ত পলিথিন রিসাইক্লিং করে, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হবে। সেটা সম্ভব না হলে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ধ্বংস, নয়তো রিসাইক্লিং করার উদ্যোগ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে। দেশের প্রতিটি জায়গায় এমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা পলিথিন ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা প্রয়োজন। রেডিও, টেলিভিশন মিডিয়ায় পলিথিন ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে বিজ্ঞাপন জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা। এলাকাভিত্তিক সামাজিক ক্লাব যুব সংগঠনগুলোর অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পট নাটিকা তৈরি করে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব। ছাড়া বৃহৎ স্বার্থে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে যদি পুরস্কার ঘোষণা করা হয় যে ময়লা বা বর্জ্য সংগ্রহ ফেলার ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার দেওয়া হবে, সেক্ষেত্রে অনেকেই আগ্রহী হয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সর্বোপরি এসব সুন্দর ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সামষ্টিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় কি করছে পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের ১২ জেলার ৪০টি উপজেলায় সিঙ্গেল ইউজ (একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়) প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশভার্জিন ম্যাটেরিয়ালব্যবহার হ্রাস করা, ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা, ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন নিশ্চিত করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস কর। ছাড়া সমুদ্র সৈকত তৎসংলগ্ন হোটেল-মোটেলে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের বিভিন্ন আইটেম পর্যায়ক্রমে বন্ধের কাজ চলছে।

পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ জেলার সব সরকারি অফিস এবং উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। ছাড়াও প্লাস্টিক পলিথিন দূষণ রোধকল্পে মাসিক সভা অংশীজনদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা সভা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতেও বলা হয়েছে।

সরকার প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণেমাল্টিসেক্টোরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশবাস্তবায়ন করছে। অবৈধ পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহন, বিক্রয়, মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বলতে আইনগতভাবে কী বোঝায় সেই সংজ্ঞাটা তৈরি করেছি আমরা। পণ্যগুলো চিহ্নিত করেছি, যেমন পানির বোতল, প্লাস্টিকের চামচ, প্লেট, স্ট্রে ইত্যাদি। এখন আমা এসব পণ্যকে সিঙ্গেল ইউজ তালিকায় নিয়ে আসব। এরপর এসবের উৎপাদন বিতরণকে নিয়ন্ত্রণ করব।

পরিসংখ্যানগত তুলে ধরে তিনি জানান, সারা বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩০ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে প্রায় হাজার মেট্রিক টন; এর মধ্যে ১০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। আগামী দুবছরে এর ব্যবহার আমরা ৯০ শতাংশ কমাতে চাই। পর্যায়ক্রমে আমরা এর উৎপাদন বিতরণ বন্ধ করতে চাই। আমরা বিষয়ে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আমরা সহজলভ্য হওয়ায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক গ্রহণ করছি।

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা ১০০ দিনের যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছি- সেখানেও দূষণের বিষয়টি নিয়ে এসেছি। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

 

×