.
কিছুটা শঙ্কা থাকলেও বেজে উঠেছে নির্বাচনী ঘণ্টা! আর মাত্র তিন মাস পর অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশ-বিদেশের সবারই দৃষ্টি নির্বাচনের দিকে। আর এই নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রকাশ্য কিংবা আড়ালে দেশের প্রতিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনীমুখী। রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী তৎপরতায় ক্রমশ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। দলের ভেতরে এবং বাইরে নেতাকর্মীদের চলছে চাঙ্গা করার চেষ্টা।
নির্বাচন নিয়ে আকাশের কালো মেঘও আস্তে আস্তে কেটে গিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকেই যাচ্ছে দেশ। আর রাজনৈতিক দলগুলোর এমন নির্বাচনী তৎপরতাকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। আনুষ্ঠানিক তফসিল ঘোষণা না হলেও দেশে শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী তোড়জোড়। এক্ষেত্রে নির্বাচনী মাঠে এগিয়ে আছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে বড় বড় শোডাউনের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার শুরুও করে দিয়েছে দলটি। পিছিয়ে নেই সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দল গোছানোর পাশাপাশি সভা-সমাবেশ করে তিনশ’ আসনেই নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। আবার পর্দার আড়লে মহাজোটের প্রার্থী তালিকাও তৈরি করে রাখছে জাপা।
অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলের প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন করলেও দলীয় কর্মসূচি ও দাবিতে নির্বাচনের নানা শর্ত উঠে আসছে। দলের হাইকমান্ড দাবি আদায় না হলে নির্বাচন নয়Ñ মুখে এমন কথা বললেও দেশের তিনশ’ আসনেই দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠ গরম রাখছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূলে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করলে তাদের দলে ধরে রাখাই যে কষ্টকর হবে, এটি ভেবে বিএনপির হাইকমান্ডও কিছুটা চিন্তিত। ফলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলনে থেকে দলকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নির্বাচনের দিকেই যেতে পারে বিএনপি, এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না দলটিরই নেতারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সব নেতাই দেশী-বিদেশী সব জায়গায় সবাইকে আশ্বস্ত করছেন, আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশন তার সব সাংবিধানিক শক্তি প্রয়োগ করে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচনকালীন সরকার শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবে। নির্বাচনে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করবে না। আওয়ামী লীগও চায়, সংবিধানের নির্দেশিত পথে ও দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তবে সংবিধানের বাইরে কোনো দাবি যে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়Ñ তা সব মহলেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা।
রবিবার এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রতি দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর আস্থা রেখেই সরকার পরিচালনা করে আসছে। জনগণই আওয়ামী লীগের একমাত্র শক্তি। তবে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার যে কোনো ধরনের অপতৎপরতা প্রতিহত করবে দেশের জনগণ। আর বিএনপি নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানাই, ষড়যন্ত্রের পথ ত্যাগ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন এবং রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা থেকে সরে আসুন।
অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দৃশ্যত এখনো অনড় রয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের কাজও এগিয়ে রাখছে দলটি। বিএনপির একাধিক উদারপন্থি নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ড এবং লন্ডন থেকে আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা, নির্বাচনী ইশতেহার এবং অন্যান্য নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে রাখা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে দৃশ্যত দাবি আদায় ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলা হলেও ভেতরে ভেতরে বিএনপিও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
তাঁদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় বর্তমান সংবিধানের অধীনে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা জেনেই বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা কৌশলে রাজপথে সরকারকে চাপে রেখেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। কারণ বিএনপির নেতারা নিশ্চিত, দেশী-বিদেশী চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও বিএনপির মতো বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মতো কিছু শর্ত সরকার মেনে নিতে বাধ্য হবে। সেক্ষেত্রে তারা দলের নেতাকর্মীদের বুঝাতে পারবে যে, তারা কিছু দাবি আদায় করেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচন বর্জন করলে দলকে টিকিয়ে রাখাই যে কষ্টকর হবে, সেটা নিয়েও চিন্তিত বিএনপির হাইকমান্ড। নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশের তিনশ’ আসনেই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে তুলতে নানা বাধা মোকাবিলা করেই কাজ করে যাচ্ছেন তারা। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিলে এসব মনোনয়নপ্রত্যাশীকে নির্বাচনী মাঠ থেকে নিষ্ক্রিয় করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে দলের কিছু সাবেক নেতাকে নিয়ে ইতোমধ্যে তৃণমূল বিএনপি গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিলে দলের অধিকাংশ প্রার্থী এই তৃণমূল বিএনপির ব্যানারে নির্বাচনে গেলে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করেই আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজও এগিয়ে নিতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই বড় দুই দলের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে কিংবা পৃথকভাবে দেশের অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলও এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, সব শঙ্কা-উৎকণ্ঠা পেরিয়ে ক্রমশ সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পথ পরিষ্কার হচ্ছে। ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন কেন্দ্রিক এই তৎপরতা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সুফল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও।
সব ঠিক থাকলে জানুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে একটি অনিশ্চয়তার শঙ্কা থাকলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে পিছিয়ে থাকতে চায় না কোন দল। প্রধান দুই দলসহ সকল রাজনৈতিক দলেই প্রকাশ্য কিংবা গোপনে চলছে নির্বাচনী প্রস্তুতি। জেলায় জেলায় চলছে নির্বাচনী তৎপরতা। বড় দুই দলের বা জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নের লাভের আশায় নানাভাবে মহড়া দিচ্ছেন। ভোটারদের মন জয় করতে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। নিজেকে যোগ্যপ্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন নির্বাচনের মাঠে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেকে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেও বাস্তবে সব রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনমুখী। বিএনপির বড় দাবিগুলো বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাস্তবায়ন সম্ভব নয়- এটা সবাই জানে। তাই বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচনের আগে বেশ কিছু দাবি আদায় করতে চাইছে। বিএনপিসহ তাদের সমমনারা দাবি আদায়ে রাজপথে সক্রিয় থাকলেও তৃণমূলে তাদের সব নেতাই ভেতরে ভেতরে নির্বাচনীর প্রস্তুতির কাজ প্রকাশ্যই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে সব রাজনৈতিক দলেরই এখন জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করে জনগণের কাছে যাওয়া উচিত বলেই মতামত ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে শুধু বড় দলগুলোই প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে তাই নয়, সমমনা কিংবা ছোট-বড় অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও জোটে নিতে কিংবা নিজেদের পক্ষে রাখতে নানা চেষ্টা চলছে রাজনীতির মাঠে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোটের মাঠে পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ। প্রতিবার সংসদের ভোট সামনে রেখে এই দুই রাজনৈতিক দল নতুনভাবে সাজায় জোটের মঞ্চ। এবারও জোটের একের পর এক দল ভিড়িয়ে শক্তির জানান দিতে চাইছে দুদলই।
আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, গত নির্বাচনের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ১৪ দলীয় জোটের ব্যানারেই অংশ নেবে। জোটের পরিধি আওয়ামী লীগ না বাড়ালেও নির্বাচনী মাঠে থাকা অসংখ্য ছোট-বড় রাজনৈতিক দলকে নিজেদের পক্ষে রাখতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখছে না তারা। বাম-ডান, অসংখ্য ইসলামী সংগঠন নানা জোট করে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে ইতোমধ্যে। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় প্রতিদিনই আত্মপ্রকাশ করছে নানা জোটের।
অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে জোটেও ভিড়েছে নানা রাজনৈতিক দল। জোটের পাল্লা ভারী করতে কিছু নামসর্বস্ব দল বা সংগঠনকে বিএনপি জোটসঙ্গী করেছে তারা। এমনও দল আছে যাদের শুধু এক নেতাই আছেন, আর কেউ নেই। দলীয় কার্যালয়, সাংগঠনিক কমিটি কিছুই নেই। গুনে গুনে সাড়ে চার ডজন, সংখ্যাটা ৫৪। সবাই বলছে তারা সরকারবিরোধী। এর মধ্যে আছে ‘এক নেতার এক দল।’ সংগঠনের শীর্ষ নেতা হিসেবে আছেন পল্টন মোড়ের মোজা বিক্রেতা, আছেন আদম কারবারিও। অধিকাংশ দলেরই নেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন। জোটে ভিড়ে নামসর্বস্ব এসব খুচরা দলও চাপে ফেলে কিছু আসন নিজেদের পক্ষে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খুচরা এসব দল নিয়েই বিএনপি এখন আন্দোলনমুখী। তবে দলটির তৃণমূল নেতারা এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী।