
জি-২০ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন শুরু হয়েছে। শহরটির প্রগতি ময়দানের ভারত মান্দাপান কনভেনশন সেন্টারে শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই সম্মেলন শুরু হয়। দুদিনব্যাপী এ সম্মেলন আজ শেষ হবে। শনিবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতারা বক্তব্য রাখেন। এর আগে আগত বিশ্ব নেতাদের অভ্যর্থনা জানান মোদি। খবর বিবিসি ও এনডিটিভি অনলাইনের।
ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে দু’দিনের আলোচনার জন্য বেশিরভাগ বিশ্ব নেতার সঙ্গে মোদি করমর্দন করেন। এদিকে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিন শনিবার বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন সদস্য দেশগুলোর নেতারা। ভারতের সভাপতিত্বে চলমান সম্মেলনে এমন অসামান্য ঐকমত্য সবার জন্যই বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা মারাত্মক দুরূহ হয়ে উঠেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি এক ঘোষণায় বলেন, সুখবর রয়েছে... আমাদের টিমের কঠোর প্রচেষ্টা এবং অন্যদের সহযোগিতায় নয়াদিল্লি জি-২০ নেতাদের সম্মেলনের ঘোষণায় ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে। তিনি বলেন, আমার অনুরোধ, এটি সব জি-২০ নেতার গ্রহণ করা উচিত। আশা করি তেমনটিই হবে। এই সময়ে আমি মন্ত্রীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা এটি সম্ভব করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ পুরি বলেন, জি-২০’র দিল্লি ঘোষণায় মোট ৭৩টি সমঝোতা এবং ৩৯টি সংযুক্ত নথি রয়েছে, যা আগের সম্মেলনগুলোর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, জলবায়ু, জলবায়ু অর্থায়ন-সবদিকে আপনি এই জি-২০’র আগে এবং পরে একটি সাধারণ পার্থক্য ধরতে পারবেন।
এটিকে ‘অত্যন্ত পরিপক্ব ও বুদ্ধিমান খসড়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ভারতীয় মন্ত্রী বলেন, ‘এটি যুদ্ধের যুগ নয়’ বলে ঘোষণা শেষ হয়েছে এটি কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে একটি বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অনুপ্রেরণা দেবে দিল্লি ঘোষণা।
এরপর জি-২০তে আফ্রিকান ইউনিয়নকে তার স্থায়ী সদস্য পদে স্বাগত জানান মোদি। ‘জি-২১ তে ব্লকের সম্প্রসারণ মোদির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক বিজয়। কারণ, তিনি আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি হবেন এবং এই বছর ফোরামের সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ হয়ে মোদি একজন আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সুযোগ পেলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে গভীর বিভক্তির কারণে সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং চীনের শি জিনপিং এবারের শীর্ষ সম্মেলন পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। মস্কো ইউক্রেনে আক্রমণের আন্তর্জাতিক নিন্দাকে জলাঞ্জলি দিতে মিত্রদের চাপ অব্যাহত রেখেছে এবং যৌথ পদক্ষেপের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের শুরু শনিবার হলেও শুক্রবারই শুরু হয় তার প্রারম্ভিক পর্ব। বহুপক্ষীয় এই আসরের অবসরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মোট ১৫টি দেশের নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁন, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলজ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজেরা শুক্রবারই নয়াদিল্লি পৌঁছান। সেজন্য সারা দিল্লিতে এখন সাজ সাজ রব।
শুক্রবার থেকেই টানা তিনদিন রাজধানী রাজ্যে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিñিদ্র ও অতিথিদের যাতায়াত নির্বিঘœ করতে প্রধান রাজপথগুলো যানমুক্ত করে রাখা হয়েছে। চমৎকারভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে গোটা রাজধানী। ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাবতীয় দৃশ্যদূষণ। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম সরগরম ও আন্দোলনকর্মীরা সরব হলেও ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ সরকার এটুকু ত্যাগ স্বীকারে বাধ্য করেছে নাগরিক সমাজকে। সম্মেলন সার্থক করে তোলাই সরকারের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু তা হবে কি না, সেই সম্ভাবনা ঘিরেই গড়ে উঠেছে জল্পনা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালি সম্মেলনে যে মতানৈক্যের শুরু, গত এক বছরে সেই তিক্ততা বেড়েছে বৈ কমেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো চায়, ‘যুদ্ধবাজ’ রাশিয়ার নিন্দা করে জি-২০ প্রস্তাব গ্রহণ করুক। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের তাতে আপত্তি তীব্র। জি-২০ সনদ অনুযায়ী, সব সিদ্ধান্ত হতে হবে সর্বসম্মত। তা না হওয়ার কারণেই সর্বসম্মতভাবে দিল্লি ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দিল্লির আয়োজনও ত্রুটিমুক্ত হতে পারল না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং এই সম্মেলনে না আসায়। তবু এই আয়োজনকে ভারতের শাসক দল বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চমকপ্রদ সাফল্য হিসেবে অভিহিত করছেন। জি-২০ সম্মেলন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্বকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ মোদি সরকারকেও শুনতে হচ্ছে। বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে এই সম্মেলনের রাজনীতিকরণের অভিযোগ বারবার উঠছে।
মোদির সামনে ‘ভারত’ প্ল্যাকার্ড ॥ জি-২০ সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের উপস্থিতিতে গোটা দুনিয়ার চোখ এখন ভারতে। আর এই আয়োজনে ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে ‘ভারত’ নেমপ্লেটের সামনে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের নাম বদলে ফেলার যে এজেন্ডা হাতে নিয়েছে বিজেপি সরকার, তারই শক্ত বার্তা এখান থেকেই। বিশ্বের কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বা শীর্ষপর্যায়ের নেতারা অংশ নিলে দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’ লেখা প্ল্যাকার্ড থাকত। কিন্তু সেই নামের ফলকই দেখা যাচ্ছে না।
সামাজিক মাধ্যমেও মোদির সামনের নামফলকের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্ব মঞ্চ থেকেই এটি প্রতিষ্ঠিত করতে একটা পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছেন মোদি।