ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

মেসি জাদুতে জেগে উঠেছে আর্জেন্টিনা

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ০০:১৯, ২৮ নভেম্বর ২০২২

মেসি জাদুতে জেগে উঠেছে আর্জেন্টিনা

.

খাদের কিনারায় দল। জয় ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। এমন কঠিন সমীকরণে এক ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে যায় ম্যাচ। আরেকটা বাজে ফলাফলের শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল আর্জেন্টিনাকে। এমন অবস্থায় আরেকবার জাদুকরী পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশকে বিশ্বকাপে টিকিয়ে রেখেছেন ক্ষুদে জাদুকর লিওনেল মেসি। শনিবার রাতে বিশ্বকাপের ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচে অধিনায়ক মেসির জাদুকরী নৈপুণ্যে মেক্সিকোকে ২-০ গোলে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক দলের প্রথম গোলটি করা ছাড়াও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার এঞ্জো ফার্নান্দেজকে দিয়ে করিয়েছেন আরেক গোল।  
সৌদি আরবের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ২-১ গোলে হেরে মিশন শুরু করা আর্জেন্টিনা এই জয়ে টুর্নামেন্টে টিকে থাকল ভালোমতোই। এখন ৩০ নভেম্বর নিজেদের শেষ গ্রুপ ম্যাচে পোল্যান্ডকে হারালে কোনো সমীকরণ ছাড়াই নকআউট রাউন্ড অর্থাৎ শেষ ষোলোতে পৌঁছে যাবে কোচ লিওনেল স্কালোনির দল। এই জয়ে দুই ম্যাচে ৩ পয়েন্ট নিয়ে ‘সি’ গ্রুপের দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে আর্জেন্টিনা। সমান ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে পোল্যান্ড।

সৌদি আরবের ৩ ও মেক্সিকোর পয়েন্ট ১। গ্রুপের শীর্ষে থাকা দুটি দল শেষ ষোলোর টিকিট পাবে। আর তলানীর দুই দলকে গোছাতে হবে তল্পিতল্পা। গ্রুপের ফরম্যাট জানান দিচ্ছে, পোলিশদের বিরুদ্ধে মেসিরা জিতলেই পরের রাউন্ডে চলে যাবে। আর জিততে না পারলে তাকিয়ে থাকতে হবে সৌদি আরব ও মেক্সিকোর মধ্যকার গ্রুপের অপর ম্যাচের ফলাফলের দিকে।  দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর রেকর্ড সর্বোচ্চ ছয়বারের ফিফা সেরা ও সাতবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী মেসি আরেকবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। প্রথম ম্যাচে হারের পর তাকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। সেই সমালোচনার জুৎসই জবাব দিয়েছেন চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে। ম্যাচটি ছিল আর্জেন্টিনার জন্য বাঁচামরার। যে কারণে মাথার ওপর ছিল পাহাড়সমান চাপ। সেই চাপকে রেকর্ডের বন্যায় ভাসিয়ে জয় করেছেন ৩৫ বছর বয়সী মহাতারকা। বলতে গেলে মেসির জাদুকরী নৈপুণ্যেই জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপ স্বপ্নও বেঁচে আছে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসার দলটির। লুসাইল স্টেডিয়ামে মহাগুরুত্বপূর্ণ এই জয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গৌরবময় রেকর্ড গড়েছেন মেসি। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
বর্তমানে পাঁচটি বিশ্বকাপে অ্যাসিস্ট করা ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় মেসি। মেক্সিকানদের বিরুদ্ধে ম্যাচের ৬৪ মিনিটে নিজে গোল করেন এবং ৮৭ মিনিটে অ্যাসিস্টে গোল করান ফার্নান্দেজকে দিয়ে। ২০০৬ সালে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে নিজের অভিষেক বিশ্বকাপেও গোল আর অ্যাসিস্ট করেছিলেন মেসি। ১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপের এক ম্যাচে গোল ও অ্যাসিস্ট করা সর্বকনিষ্ঠ এবং বয়স্ক ফুটবলারের দুটি রেকর্ডই এখন মেসির দখলে। ম্যাচে নিজের গোলটি ডি বক্সের বাইরে থেকে বা পায়ের মনোমুগ্ধকর শটে করেন মেসি। বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারে বক্সের বাইরে থেকে করা এটি তার চতুর্থ গোল। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর কেবল একজনই (ব্রাজিলের রিভেলিনো ৫ গোল) বিশ্বকাপে মেসির চেয়ে বেশি গোল করতে পেরেছেন ডি বক্সের বাইরে থেকে। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে দলকে জিতিয়ে ম্যাচসেরাও হয়েছেন ক্ষুদে জাদুকর।
বিশ্বকাপের মঞ্চে সবচেয়ে বেশি ম্যাচসেরা (২০০২ সাল থেকে এই পুরস্কার শুরু) হওয়ার রেকর্ডে মেসি যৌথভাবে শীর্ষে আছেন আরেক সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে। দুজনই সাতবার করে বিশ্বকাপে ম্যাচসেরা হয়েছেন। ৬ বার ম্যাচসেরা হয়েছেন হল্যান্ডের সাবেক তারকা ফরোয়ার্ড আরিয়ান রোবেন। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেই মেসি পাশে বসেন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ২১ ম্যাচ খেলা দিয়াগো ম্যারাডোনার। পরে গোল করে আবারো ২০২০ সালে ওপারে পাড়ি জমানো সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকাকে স্পর্শ করেন। আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ম্যারাডোনা বিশ্বমঞ্চে ২১ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন আটটি। সৌদি আরবের পর মেক্সিকোর বিরুদ্ধেও জালের দেখা পেয়ে মেসিরও হয়ে গেছে আট গোল। ১০ গোল করে আর্জেন্টাইনদের মধ্যে সবার ওপরে আছেন ‘বাতি গোল’ খ্যাত সাবেক তারকা ফরোয়ার্ড গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা।
মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের প্রথমার্ধে অবশ্য সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর্জেন্টিনাকে। মেক্সিকোর খেলোয়াড়দের কড়া মার্কিংয়ে এ অর্ধে তেমন সুযোগই সৃষ্টি করতে পারেন নি মেসি, মারিয়া, মার্টিনেজরা। কিন্তু বিরতির পর দারুণভাবে জেগে ওঠেন দিয়াগো ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা। এটা সম্ভব হয়েছে মেসি ম্যাজিকের কারণেই। ম্যাচ শেষে তাই ড্রেসিংরুমে উদ্দাম নৃত্য করতে দেখা গেছে আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের। এখন লিওনেল স্কালোনির শিষ্যদের চোখেমুখি স্বস্তির ছোঁয়া। মেসিও উচ্ছ্বসিত ঘুরে দাঁড়ানো জয়ে। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যাচ শেষে বলেন, ‘এখন থেকে আর্জেন্টিনার আসল বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে। আমাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস ছিল। ফুটবলপ্রেমীদেরও বিশ্বাস রাখতে বলবো। আমরা সেটাই করেছি; যেটা আমাদের করার দরকার ছিল। আমাদের সামনে  কোনো দ্বিতীয় পছন্দ ছিল না। আমাদের জিততেই হতো। আমরা শুধু নিজেদের উপরই ভরসা রেখেছিলাম। আশা করছি সামনের ম্যাচেও দল ভাল করবে।’
স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত আর্জেন্টিনার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া বলেন, ‘ খুবই খুশি হয়েছি। এ জয় আমাদের প্রাপ্য ছিল। প্রথম ম্যাচে আমরা হেরে যাই। তবে এবার আমরা মানুষের জন্য, নিজেদের জন্য, নিজেদের পরিবারের জন্য আনন্দ নিয়ে আসতে পেরেছি।’ কঠিন ম্যাচ জিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কালোনিও। শিষ্যদের নিয়ে গর্বিত এই কোচ বলেন, ‘ছেলেদের খেলা দেখা সত্যিই দারুণ। যারা এই দলে আস্থা রাখে না তারা আর্জেন্টিনাকে সত্যিই ভালোবাসে না। সত্যিকার অর্থেই ছেলেরা খুব ভালো খেলেছে। ওদের নিয়ে আমি গর্বিত।’ মেক্সিকোর কাছে হারলেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যেত আর্জেন্টিনার। ড্র করলে কাগজে কলমে টিকে থাকলেও আদতে নকআউট পর্বের সম্ভাবনা খুব একটা থাকত না। সঙ্গত কারণেই এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতে উচ্ছ্বাসে ভাসছে আর্জেন্টিনা দল।

 

×