নতুন শিক্ষা কারিকুলাম
প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে ঢালাওভাবে সাজানো হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। এর জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে শিক্ষা বিভাগ। ইতোমধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ নামে নতুন কারিকুলামটি জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি) কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু এরইমধ্যে এই কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে নানা ধরনের গুজব। বিশেষ করে একটা শ্রেণী প্রচার করে নতুন শিক্ষাক্রমে একটি বইয়ের মাধ্যমে সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে। আর এতে করেই তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে এটি পুরোপুরি গুজব। ধর্মশিক্ষা বাদ দেয়া তো দূরে থাক প্রত্যেক ধর্মের জন্য প্রত্যেক শ্রেণীতে দেয়া হবে আলাদা পাঠ্যবই। শুধু তাই নয় বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে গুঞ্জন উঠেছে। যা ঠিক নয় বলে জানা গেছে। যৌন শিক্ষা নয় বরং প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে জানতে অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। চাপে নয় বরং আনন্দে শিক্ষার জন্যই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর তাই এটি বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
শিক্ষার্থীরা আর চাপে নয় বরং আনন্দের সঙ্গে শিখবে। নতুন কারিকুলামে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকছে না। তুলে দেয়া হবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি)ও। শুধু তাই নয় নতুন এই কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যন্ত কোন বিভাগ বিভাজন থাকবে না। আর উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছরের পরীক্ষা মূল্যায়ন করে দেয়া হবে চূড়ান্ত ফলাফল। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন কারিকুলামে সব শ্রেণীতে জোর দেয়া হবে শিখনপদ্ধতির ওপর।
নতুন শিক্ষাক্রমে ধর্মশিক্ষার বিষয়ে বলা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক ধর্মের বইয়ে তিনটি শিখন ক্ষেত্র রয়েছে। এগুলো হলো ধর্মীয় জ্ঞান, ধর্মীয় বিধিবিধান ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে টিচিং লার্নিং সিস্টেম এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজ নিজ ধর্মের আচার-ব্যবহার, বিধিবিধানগুলো পড়ার পাশাপাশি গ্রুপ স্টাডির মাধ্যমেও আলোচনা করবে।
এরপর শিক্ষার্থীরা এগুলো বিদ্যালয়ের দেয়ালিকায় উপস্থাপন করবে। এতে শিক্ষার্থীরা সব ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারবে উল্লেখ করে এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সমন্বিত শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক ধর্মের জন্য আলাদা পাঠ্যবই থাকবে। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে একটি বইয়ের মাধ্যমে সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে, বিষয়টি ঠিক নয়।
শুধু তাই নয় বর্তমান পাঠ্যক্রমে আমাদের একটি বিষয় আছে যার নাম ‘চারুকলা’। নতুন শিক্ষাক্রমে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’। এর ফলে এ বিষয়ে শিখন ক্ষেত্র অনেক বাড়বে। আগে যেমন এ বিষয়ে শুধু চারুকলাকে ফোকাস করা হতো, এখন চারুকলার পাশাপাশি নৃত্যকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয় থেকে শিক্ষার্থী জানতে পারবে।
বিষয়টি প্রাথমিকে থাকবে শিল্পকলা নামে এবং মাধ্যমিকে শিল্প ও সংস্কৃতি নামে। অন্যদিকে ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা’ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গেও পরিচিত হবে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, যেকোন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যেন মানসিক দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারে, এ জন্য কিছু মৌলিক জ্ঞান এ বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অর্জনের সুযোগ পাবে। এর ফলে শিশুরা সব ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার সক্ষমতা অর্জন করবে। প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত অধ্যায়ে কী কী থাকবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, জন্ম থেকেই আমাদের সবাইকেই (ছেলে ও মেয়ে) প্রজননের বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
এ বিষয়ে যেন শিক্ষার্থীরা সুস্পষ্ট ধারণা পায়, এ জন্য আমরা ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা’ বিষয়ে প্রজনন স্বাস্থ্য নামে অধ্যায় রেখেছি। অন্যদিকে ‘জীবন ও জীবিকা’ বিষয়টি হবে পেশাভিত্তিক। নবম ও দশম শ্রেণীতে এ বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি পেশায় দক্ষতা অর্জন করবে। এতে দশম শ্রেণী শেষে একজন শিক্ষার্থী যেকোন একটি পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে কী পড়ানো হবে, এমন প্রশ্নে এনসিটিবির এই সদস্য বলেন, বর্তমান শিক্ষাক্রমে আমাদের আইসিটি নামে একটি বিষয় আছে। এই বিষয়টির ব্যাপ্তি বাড়িয়ে এর নাম দেয়া হয়েছে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি’। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আইসিটির প্রাথমিক জ্ঞান আহরণ করার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সতর্কতা, অনলাইন ক্রাইম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নিয়মকানুন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারবে।
গত জুন জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি) নতুন এই কারিকুলাম চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেয়। এ সময় জানানো হয়, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত চলমান শিক্ষাক্রমের ভুলত্রুটি সংশোধন, আন্তর্জাতিক মান ও সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বর্তমান কারিকুলাম আধুনিক করছে সরকার।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকছে না। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে হবে আটটি বই। তবে সব শ্রেণীতেই শিখনকালীন মূল্যায়নেই বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এই পদ্ধতিতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা থাকছে না।
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে, মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকবে না মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ক কোন বিভাজন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর সবাইকে পড়তে হবে ১০টি বিষয়। দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর ওপরই অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। তবে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি অকুপেশনে দক্ষতা অর্জন করবে এবং ১০ম শ্রেণী শেষে যেকোন একটি অকুপেশনে কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করবে।
বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার বিবরণীতে বলা হয়, নতুন কারিকুলামে প্রমিত বাংলা ভাষায় ভাব আদান-প্রদানের (শোনা, বলা, পড়া, লেখা, দেখা ও অনুভব করার) মৌলিক দক্ষতা অর্জন করা সাহিত্যপাঠে আনন্দ লাভ করতে সমর্থ হওয়া, বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সৃজনশীল ও শৈল্পিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারা এবং পরমতসহিষ্ণুতার সঙ্গে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কার্যকর ও কল্যাণমুখী যোগাযোগে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য।
জানা যায়, নতুন কারিকুলামে প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষাসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয় থাকবে। আর মাধ্যমিক স্তরে বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়েও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
এছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসায় স্তরভিত্তিক নির্বাচিত বিষয়গুলোর সঙ্গে মাদ্রাসায় কুরআন, হাদিস ইত্যাদি এবং কারিগরিতে ট্রেডের বিশেষায়িত বিষয়গুলোর যৌক্তিক সমন্বয় থাকবে। আর মাধ্যমিকে (একাদশ ও দ্বাদশ) আবশ্যিক বিষয় থাকবে ৩টি। নৈর্বাচনিক বিষয়ও থাকবে যেকোন তিনটি। তবে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় তালিকা থেকে যেকোন তিনটি বিষয় নেয়ার সুযোগ থাকবে। এছাড়া প্রায়োগিক বিষয় হিসেবে যেকোন একটি পেশাদারি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য নির্বাচিত বিষয়গুলো থেকে যে কোন একটি বিষয় নেয়ার সুযোগ থাকবে।
স্তরভিত্তিক মূল্যায়ন কৌশলের বিষয়ে বলা হয়, শ্রেণীকক্ষে শিখনকালীন সময়েই তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন হবে। আর ৪র্থ থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শ্রেণীকক্ষে শিখনকালীন সময়ে মূল্যায়ন হবে ৬০ ভাগ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ ভাগ। এছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা বিষয়ে পুরোটাই শ্রেণীকক্ষে শিখনকালীন সময়ে মূল্যায়ন হবে। একইভাবে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান এবং ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ ভাগ। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ ভাগ।
এছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। ৯ম-১০ম শ্রেণীতে (পাবলিক পরীক্ষাসহ) বাংলা, ইংরেজী, গণিত, বিজ্ঞান এবং ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে শিখনকালীন সময়ে মূল্যায়ন হবে ৫০ ভাগ, সামষ্টিক মূল্যায়নও ৫০ ভাগ। আর জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি শিখনকালীন মূল্যায়ন ১০০ ভাগ। দশম শ্রেণী শেষে দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর ওপর থাকবে পাবলিক পরীক্ষা। অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে শ্রেণীকক্ষে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ ভাগ। আর সামষ্টিকভাবে মূল্যায়ন হবে ৭০ ভাগ।
নৈর্বাচনিক/বিশেষায়িত বিষয়ে কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রায়োগিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যসূচীর ওপর প্রতিবছর শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে যা বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষা হিসেবে প্রচলিত। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।
জানা যায়, চলতি বছর মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাইলটিং শুরু হয়েছে। আগস্টে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণীর পাইলটিং শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। ২০২৩ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। ২০২৪ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণী এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণী যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণী যুক্ত হবে।
ইতোমধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের ৬২টি স্কুল, কারিগরি ও মাদ্রাসায় পাইলটিং শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে। আর সবগুলো প্রতিষ্ঠান থেকেই খুব ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি জনকণ্ঠকে বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। যেখানে প্রচলিত পেশার ৩ ভাগের ২ ভাগ ২০৩০ সালের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক শিক্ষায় আছে তারা কর্মজগতে প্রবেশ করে যে কাজ করবে তা এখনও অজানা।
ভবিষ্যতের জীবন ও জীবিকার জন্য প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা সম্ভব নয় বরং রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা ও যোগ্যতায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। যেন তারা নিজেরাই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সর্বোচ্চ পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারে। তিনি বলেন, পাইলটিং শেষে আগামীবছর প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে নতুন কারিকুলাম। সঙ্গে অন্য স্তরেও পাইলটিং শুরু করা হবে। মন্ত্রী বলেন, নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য ব্লেন্ডেড লার্নিং অনেক জরুরী। কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখবে। এটি সে ক্লাসে, বাড়িতে, বন্ধু ও প্রতিবেশীসহ অনেকের কাছ থেকে শিখতে পারবে। শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামে পড়ার চেয়ে কাজ বেশি। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে কাজ দেয়া হবে। তারা সেটি করে শিক্ষকদের কাছে জমা দেবে। এখানে তেমন বোঝানোর কিছু নেই। কাজের মাধ্যমে সে শিখবে। সে কাজের ওপর তার অভিজ্ঞতা তৈরি হবে। আমরা সেসব নিয়ে কাজ করছি। সারাদিন সে কী করেছে সেটি ডায়রিতে লিখতে বলা হতে পারে। পড়ার সময় জানবে তার কী কী করা উচিত আর সে কী করেছে।
প্রতিদিন তার কী কী খাওয়া উচিত আর সে কী খেয়েছে সেটি সে নিজেই বুঝতে পারবে। প্রতিদিন তারা নিজের কাজ নিজে করবে। সেগুলো এখন পাঠ্য হয়ে গেছে। যেগুলো বাসায় রেখেও করা সম্ভব হবে। কিছু কিছু কাজ আছে শিক্ষকরা যদি ফোনেও বলেন তাহলেও সেটি করা সম্ভব। আমরা এরইমধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ক্লাসের জন্য প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষক নির্দেশিকা দেয়া হবে। সেখানে কী কী করতে হবে, দেয়া হবে সে সংক্রান্ত ধারণা। প্রতি সপ্তাহে একদিন কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে শিক্ষকরা আলোচনায় বসে কোন সমস্যা থাকলে সেসব নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করা হবে ।
এটি পদ্মা সেতু তৈরির মতোই বড় একটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু তৈরি করা তো সহজ ছিল না। কিন্তু এটি করতে হয়েছে। আমাদেরও এটি করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করার মতো তৈরি করতে এটি আমাদের করতে হবে। এর জন্য শিক্ষকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ শুরু করেছি। এ বছরের মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে বলে আশা করছি।
তবে এক্ষেত্রে অভিভাবকদের মানসিকতাও পরিবর্তন করা জরুরী উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, একটা প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যে থাকতে থাকতে মানুষের মধ্যে অভ্যস্থতা তৈরি হয়ে যায়। তখন নতুন কিছুকে গ্রহণ করা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের সন্তানদের জন্য, তাদের হাতে কলমে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার জন্য এটি জরুরী। তাই সবার সহযোগিতা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গেই জয়ী হতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বলা হচ্ছে, ধর্মশিক্ষা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। সব শ্রেণীর পাঠ্যসূচী থেকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত সবকিছু বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাইকে অনুরোধ করব সত্যতা যাচাই করুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আমাদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার খোলনলচে বদলে ফেলছি। আমরা শিক্ষায় পরিবর্তনের কথা বলছি না, সংস্কারের কথা বলছি না, রূপান্তরের কথা বলছি। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন আমাদের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করতে না পারে। সব ধর্মের নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।