ট্র্রাক লরি
সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় নিত্যপণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দাম বাড়বে ভোগ্য ও সব ধরনের নিত্যপণ্যের। বিশেষ করে ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপসহ অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া ইতোমধ্যে বেড়ে যাওয়ায় পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তাদের হাতে পণ্য পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত ‘সাপ্লাই চেন’ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক বন্ধ রাখা হয়েছে। পণ্য সরবরাহ কমেছে ঢাকার প্রধান পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত কাওরানবাজারে। সরবরাহ কমায় প্রতিকেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। সবজির দামও চড়া। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জানা গেছে, তেলের দাম সমন্বয় করতে ভাড়া বৃদ্ধির দাবি করছেন পরিবহন মালিকরা। দেশের বেশিরভাগ পণ্যবাহী ট্রাক ও লরিগুলো এখন বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়ক ও মহাসড়কে কমে গেছে বাসের মতো গণপরিবহনও। এ অবস্থায় পণ্যবাহী ট্রাক লরি, কাভার্ডভ্যান এবং পিকআপ চলাচল দ্রুত স্বাভাবিক করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দ্রুত জ্বালানি তেলের সঙ্গে বাড়াবৃদ্ধির বিষয়টি সমন্বয় করতে হবে।
এতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকা আসতে আগে যে পরিমাণ ট্রাক ভাড়া গুনতে হতো এখন থেকে তা দেড়গুণ বৃদ্ধি পাবে। এতে আগে যে ট্রাক ভাড়া ১০ হাজার টাকা ছিল এখন সেই ভাড়া হবে ১৫ হাজার টাকা। এর প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। এতে দাম বেড়ে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। শুধু তাই নয়, সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে যেসকল সিন্ডিকেট চক্র সংক্রিয় হয়ে উঠে তারাও এখন সুযোগ নিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। একারণে দ্রুত পণ্যবাহী যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার ওপর সর্বেচ্চ জোর দেয়া হয়েছে।
শনিবার রাত পর্যন্ত সরকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে একাধিক বৈঠক করা হয়। কি ধরনের কৌশল গ্রহণ করলে পণ্যপরিবহন স্বাভাবিক রাখা যায় সে বিষয়ে নজর রাখছে সরকার।
এদিকে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে গত দুবছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছিল। এ সময় দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি, সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্রদান, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন এবং দেশের সবাইকে টিকার আওতায় আনার মতো চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে। কিন্তু বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে দেশে এখন সব ধরনের খাদ্যপণ্য আকাশচুম্বী দামে বিক্রি হচ্ছে।
আমদানি ব্যয় মেটাতে ৯ মাসের মজুদকৃত রিজার্ভ কমতে কমতে তলানীতে এসে ঠেকেছে। এখন চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে সরকারের কাছে। চারদিকে ডলারের জন্য হাহাকার। ডলার বাজারে ঢুকে পড়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেটচক্র। রিজার্ভ বাড়াতে রেমিটেন্স এবং রফতানি আয়ের পাশাপাশি এখন বড় অঙ্কের ঋণ নিতে চেষ্টা করছে অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ দিতে আলোচনা শুরু করেছে।
তবে ঋণ পেতে বেশকিছু শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে বিদ্যুত জ্বালানি ও কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর শর্তটি অন্যতম। চলতি বাজেটে বিভিন্ন খাতে ৮৩ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি ঘোষণা করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন আইএমএফের পরামর্শে সম্প্রতি ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো এবং সর্বশেষ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো। যদিও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার এক বৈঠক শেষ জানিয়েছিলেন, দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী হয় এরকম কোন শর্ত মেনে আইএমএফের ঋণ নেয়া হবে না। বাজেট সহায়তা নামে যে ঋণ চাওয়া হয়েছে তা দেশের মানুষের কল্যাণের জন্যই।
কিন্তু সার ও বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা সমন্বয়ের নেতিবাচক প্রভাব এখন নিত্যপণ্যের বাজারে। ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের বাজারে কোন জিনিসের দাম কমার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং একের পর এক বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, চিনি, শাক-সবজি ও মাছ-মাংসের মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে।
ব্যবসায়ীরা সরকারের পলিসিকে দায়ী করে বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বেই। পরিবহন খরচ বাড়লে এমনিতে সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে এখন যে কোন পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। শিল্পের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হবে। অর্থনীতিতে নতুন চাপ তৈরি করবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, একবারে জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানো সঠিক হয়নি। মূল্য সমন্বয় ধাপে ধাপে করা গেলে তা মানুষের কাছে সহনীয় থাকত।
কিন্তু এখন ৫০ শতাংশের ওপরে বেড়ে যাওয়ায় ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। গত দুবছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু খরচের পাল্লা ভারি হচ্ছে। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সাপ্লাই চেন ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় পণ্যপরিবহনে ট্রাকভাড়া নির্ধারণে মিটারিং সিস্টেম করা যায় কিনা সে বিষয়েও ভাবতে হবে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বাজারে আগের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। তবে শনিবার কাওরানবাজারে কিছুটা কমেছে সবজির সরবরাহ। সরবরাহ কমায় দাম বেড়ে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ ৩০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দামও চড়া। কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভাড়া বাড়ানোর দাবি করছেন ট্রাক মালিকরা। ফলে ট্রাকের অভাবে আড়তার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা কৃষিপণ্য বিশেষ করে শাক-সবজি আনা কমিয়ে দিয়েছেন।
যারা আনছেন, বেশিভাড়া দিয়ে আনতে হচ্ছে। এতে সবজিসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে। এ প্রসঙ্গে ওই বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মোঃ জসিম জনকণ্ঠকে বলেন, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে ট্রাক ভাড়া বেড়ে গেছে। ফলে সরবরাহ কিছুটা কমেছে। এখন থেকে পণ্য আনতে হলে বেশি ভাড়া দিয়েই আনতে হবে। এতে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে।