ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কৌশল পাল্টেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা

প্রকাশিত: ২২:০৬, ১২ মার্চ ২০২২

কৌশল পাল্টেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা

ফজলুর রহমান ॥ মেয়ের জন্য বই কিনতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসেন আতাউর রহমান (৫৫)। ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনযোগে রামপুরা যাচ্ছিলেন তিনি। পাশের সিটের বাসযাত্রী পথিমধ্যে তার কাছে পানি খেতে চান। হাতে থাকা পানির বোতলটি ওই যাত্রীকে দেন আতাউর। পানি খেয়ে বোতলটি আবার আতাউরকে ফেরতও দেন ওই যাত্রী। কিছুক্ষণ পর আতাউর নিজেও ওই বোতলের পানি খান, এরপর আর কিছুই মনে নেই তার। পথিমধ্যে হাতিরঝিল থানাধীন আবুল হোটেল সংলগ্ন নুর মসজিদের সামনে আতাউরকে ফেলে রেখে যায় বাসটির স্টাফরা। পরে মসজিদের নিরাপত্তাকর্মী হাবিবুর রহমান খবর দিলে হাতিরঝিল থানার এসআই শরিফুল এসে আতাউরকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে পাকস্থলী ওয়াশের পর চিকিৎসকের পরামর্শে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। পাকস্থলী ওয়াশ করানোর এক ফাঁকে আতাউরের জ্ঞান ফিরে। এ সময় স্বজনের নাম্বার নিয়ে আতাউরকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেন এসআই। অজ্ঞান পার্টির সদস্য আতাউরের টাকা, মোবাইল নিয়ে গেলেও এ ঘটনায় তিনি কিংবা তার পরিবার থানায় মামলা তো দূরের কথা, কোন অভিযোগও করেননি। জানতে চাইলে এসআই শরিফুল বলেন, ভুক্তভোগী কিংবা তার পরিবারের কেউ মামলা করেননি। মামলা করবেও বা কার বিরুদ্ধে? স্ত্রীর জন্য স্বর্ণের গয়না, মা ও পরিবারের সবার জন্য উপহার কিনেছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী জাহিদুল ইসলাম। গত ১৩ জানুয়ারি বিমানযোগে ঢাকায় ফেরেন। দুপুরে উত্তরা থেকে শাহ ফতেহ আলী নামের একটি বাসে ওঠেন বগুড়ায় যাওয়ার জন্য। পথিমধ্যে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে পরিবারের জন্য কেনা সব খুইয়ে বাড়ি ফেরেন জাহিদুল। এ ঘটনার পর শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেছিলেন, ভুক্তভোগী জাহিদুলের স্ত্রী জান্নাতি খাতুন থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের আলোকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মাস দেড়েক পর গত রবিবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ঘটনাটি তো টঙ্গী কিংবা মাওনা থানাধীন ঘটেছে। আমরা তাদের সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করতে তখনই পরামর্শ দিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু তার জানা নাই, বললেন ওসি। রাজধানীতে হরহামেশাই এ রকম অজ্ঞান পার্টির ঘটনা ঘটছে। প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ এদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। বিদেশ থেকে দেশে এসে প্রবাসীদের খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে আপনজনদের কাছে। এদের খপ্পরে পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তা সত্ত্বেও কেউ আইনী প্রতীকার চেয়ে আইনী ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ভুক্তভোগীদের মধ্যে হাতেগোনা ২-৪ জন থানায় গেলেও এসব ঘটনায় মামলা নিতে অনীহা পুলিশের। এদের খপ্পরে পড়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেই কেবল মামলা হয়। ফলে লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের। গর্হিত অপরাধ করেও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাহিরে। পুলিশ বলছে, অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া ব্যক্তির খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি না হলে, ভুক্তভোগী কিংবা পরিবারের লোকজন মামলা করতে চান না। এ ঘটনায় কেউ মারা গেলে তখন ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা করেন। অভিযোগ না করায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ারও সুযোগ থাকে না তেমন। আক্রান্তদের পরিসংখ্যানও উঠে আসে না। অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য জানান, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এলাকা ভাগ করে অপারেশন পরিচালনা করে। টার্গেট ব্যক্তি এলাকার বাইরে চলে গেলে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় অন্য টিমের কাছে। রাজধানীর জনবহুল এলাকায় ওঁৎপেতে থাকে তারা। এ কাজের সঙ্গে অবশ্য জড়িত রেলস্টেশনে ভবঘুরে, ফুটপাতের শরবত বিক্রেতা, বস্তির উঠতি যুবকরা। তবে বাসের চালক কিংবা হেলপার জড়িত থাকার অভিযোগও করছেন কোন কোন ভুক্তভোগী। টাকা-পয়সা আছে, এমন ব্যক্তিকে টার্গেট করে তারা। অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের যত কৌশল ॥ বিভিন্ন সময়ে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এ দলের সদস্যদের অভিন্ন কৌশল সম্পর্কে জানা যায়। গত ৪ জানুয়ারি ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে করে নর্দ্দা থেকে গুলিস্তান যাওয়ার পথে এমনই এক অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন ব্যবসায়ী বিপুল ঘোষ। তার ধারণা, পাশের সিটে বসা ব্যক্তি নাকের কাছে কিছু ছিটিয়ে অজ্ঞান করে দেয় এবং সঙ্গে থাকা ৫০ হাজার টাকা, মোবাইল, ব্যাগ সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই চেতনানাশক এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বিপুলের জ্ঞান ফিরতে তিনদিন পেরিয়ে যায়। মূলত অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা পুরানো কৌশল বদলে নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। চক্রের সদস্যরা যাত্রী সেজে বাস, লঞ্চ, ট্রেন স্টেশনে অবস্থান করে। যেখানেই টাকা-পয়সা, দামী মোবাইল কিংবা মূল্যবান জিনিসপত্র আছে- এমন কাউকে টার্গেট করে। টার্গেট ব্যক্তির পাশে, পিছে কিংবা সামনের আসনের টিকেট কাটে। টার্গেট ব্যক্তি ঢাকার বাইরে যাওয়ার টিকেট কাটলে চক্রের সদস্যরাও তাই করে। লক্ষণ বুঝে টার্গেট ব্যক্তির সঙ্গে কথায় সুর মিলায়, গড়ে তোলে সখ্যতা। খাবারের বিরতির জন্য পথিমধ্যে বাস দাঁড় করালে একই টেবিলে বসে খান। এরপর চা কিংবা কোমল পানীয় পান করেন। এই খাওয়া-দাওয়ার মাঝেই যাত্রী বেসে থাকা অজ্ঞান পার্টির সদস্য হয় নাস্তার সঙ্গে, নয়ত চা কিংবা কোমল পানির সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে টার্গেট ব্যক্তিকে পান করায়। এতে অল্প সময়ের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন টার্গেট ব্যক্তি। তার সর্বস্ব নিয়ে চম্পট দেয় চক্রের সদস্য। এছাড়া কেউ ক্যানভাসার সেজে তার পণ্যের প্রচারের বক্তৃতা শুরু করে। দাবি করা হয়, তার এই খাদ্যপণ্য উত্তেজক এবং খুবই ফলদায়ী। এ সময় ওই দলের যে সদস্য বাসযাত্রীর পাশে বসে, সেও আগে ওই খাবার কিনে খেয়েছে এবং ফল পেয়েছে বলে জানায়, বাস থেকেই কিনেছিল এবং ওই ব্যক্তির কাছ থেকেই। সে নানাভাবে ওই পণ্যের গুণগান শুরু করে এবং একপর্যায়ে বাসযাত্রীকে খাইয়ে দেয়। ইয়ামিন নামের আরেকজন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে জানা গেল এ দলের সদস্যদের আরেকটি কৌশলের কথা। বাসের জানালার পাশে বসা ইয়ামিন। তার পাশেই বসা সমবয়সী এক যুবক। ওই যাত্রী ইয়ামিনের নাক-মুখের সম্মুখে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে থু থু ফেলে। এ সময় তার হাতে থাকা রুমাল কিংবা টিস্যু পেপার ইয়ামিনের নাকে লাগে। এর কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান হারান ইয়ামিন। এ রকম নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পেশার লোকদের খপ্পরে ফেলছে চক্রের সদস্যরা। ইদানীং আতরের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়েও কম দামে বিক্রির নামে মাঠে কাজ করছে চক্রটি, গোয়েন্দা সূত্রে এমনটিই জানা গেছে। পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া ব্যক্তিরা হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। এসব ঘটনায় মামলা না করায় আসামিদের ধরলেও গ্রেপ্তার দেখানো মুশকিল হয়ে পড়ে। আর যেসব ক্ষেত্রে একান্তই মামলা করতে হয়, তখন পুলিশকেই বাদী হতে হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না। তাই আদালতে গিয়ে খুব সহজেই জামিনে বেরিয়ে একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। তবে ২-১টি ঘটনায় মামলা করলেও এদের আইনের আওতায় আনার সংখ্যা খুবই কম। গত ১৬ জানুয়ারি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য এএসআই মীর আঃ হান্নান (৫৮)। এ ঘটনায় নিহতের ভাতিজা বাদী হয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। দেড় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও পুলিশ ঘটনায় জড়িত চক্রের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শামীম নামে সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদেও মুখ খুলেনি সে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনার সঠিক কোন ক্লু এখনও পাওয়া যায়নি। তাই ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারে বেগ পেতে হচ্ছে। মামলাটি পিবিআই, ডিবিও ছায়া তদন্ত করছে। কিন্তু এএসআই হান্নান মাঝপথে ভিকটিমের শিকার হয়েছেন। কোন সিসিটিভির ফুটেজ নাই, চলন্ত অবস্থায় ঘটনাটি ঘটেছে। তাই রহস্য উদঘাটন করা এখনও সম্ভব হয়নি। প্রাণক্ষয় যে কারণে ॥ চিকিৎসকরা জানান, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা মূলত রোরাজিপাম গ্রুপের ‘এপিট্রা’ নামে এক ধরনের তরল ওষুধ এবং নক্টিন ট্যাবলেট ব্যবহার করে। ওষুধ দুটি মূলত দুশ্চিন্তা বা প্যানিক এ্যাটাকের বিপরীতে কাজ করে। এছাড়া এরা আরও কিছু ওষুধ ব্যবহার করে। তবে এগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ। হার্টের সমস্যা, উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও লিভারের রোগ থাকে তাহলে মৃত্যুর ঝুঁঁকি অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনতে দেরি হলেও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের তথ্যানুযায়ী, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যান। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মাসে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে। এদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঢামেকে পাকস্থলী ওয়াশ করানোর পর এদের মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে এসব রোগীদের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার জনকণ্ঠকে জানান, অজ্ঞান পার্টির যে সকল পুরানো সদস্য আছে, আবার জামিনে আছে- তাদের ধরে পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। কিছুসংখ্যক ধরাও পড়েছে। এক্ষেত্রে ভিকটিম আর আসামি এক করা যায় না, এটা একটা সমস্যা। যারা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ছে, তাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাহিরের। বিভিন্ন জেলা থেকে কাজে ঢাকায় এসে সখ্যতার খাতিরে কিছু খেতে গিয়েই আক্রান্ত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই। তবে তার মতে, অজ্ঞান পার্টির ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বাড়েনি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভুক্তভোগীদের মামলা করা উচিত। তবে আগের মামলার সূত্র ধরে ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা চক্রের সদস্য ও হোতাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসি। কেননা, যে মানুষকে অজ্ঞান করার কাজে এক্সপার্ট, সে জামিনে বেরিয়ে এ কাজই করবে। আমাদের কাছে তাদের তথ্য, তালিকা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।
×