
কামরুজ্জামান বাচ্চু ॥ পটুয়াখালীর বাউফলের ধুলিয়া গ্রামের মিজান গার্ডেনে নানা প্রজাতির দেশী ও বিদেশী ফল ও ফুলের গাছ দেখে বিমোহিত হবেন যে কেউ। তার বাগানে তিন বছর বয়সের গাছে থোকায় থোকায় মাল্টা ধরেছে। জলপাই, জাম্বুরা, থাই জাম্বুরা, কামরাঙা, বেরাকাটা লেবু, বেরাকাটা পেয়ারা, পার্সিমন, রাম্বুটান, খাটো জাতের থাই নারিকেলসহ রয়েছে রেডলেডি জাতের পেঁপে, লাউসহ সবজির বাগান। ওই বাগানে নানা জাতের গোলাপ, রজনীগন্ধা, কামিনী, জবা, জিনিয়া, আলমন্ডা, প্যারাডাইস, মাধবীলতা, গোল্ডেন শাওয়ার, মেফ্লোয়ার, লিলি, সজনেসহ দেশী-বিদেশী শোভাবর্ধক গাছও রয়েছে। মহাছনক, পালমার, সূর্যডিম, মিসস্পেশাল, পুনাই, পুনাই লাল, ম্যাট্রাস, ম্যাট্রাস তোঁতা, হাঁড়িভাঙ্গা, চিনের কিউজাইসহ নানা জাতের আম গাছের পাশাপাশি রয়েছে ভেষজ গাছও।
মিজানুর রহমান টিটু বছর তিনেক আগে প্রায় ৮ একর জমির ওপর গড়া নিজের শখের বাগান বাড়িতে ‘মিজান গার্ডেনে’ পার্সিমন, রাম্বুটান, ড্রাগন, প্যাশন, জাম্বুরা, পেঁপে, পেয়ারা, কমলার মতো নানা জাতের দেশী-বিদেশী ফলের গাছ রোপণ করেন। তিনি বরিশালের স্বরূপকাঠীর একটি নার্সারি থেকে শতাধিক মাল্টা চারা এনে তার বাগানে রোপণ করেন। এরপর ৪-৫ জন কর্মচারী নিয়ে নিয়মিত পরিচর্যা ও দেখভাল করতে থাকেন। কেঁচো কম্পোস্ট, ভার্মিকম্পোস্ট, খৈল, গোবর, জৈবসার আর প্রাকৃতিকভাবে পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা বাগানের ওইসব গাছে এখন থোকায় থোকায় ঝুঁলছে মাল্টা আর কমলালেবু। ফলের ভারে পুরো বাগানের গাছগুলো যেন ন্যুয়ে পড়েছে।
বাগান সৃজন ও পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা তুষার ইমরান জানান, মাটিতে গোয়ালঘরের গোবর মিশিয়ে রোপণ করা হয় নাগপুরী, বারি-১, চায়না, এলাচি, বেড়াকাটা জাতের কমলা ও পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান বারি জাতের শতাধিক মাল্টা চারা। রাসায়নিক সার ওষুধ ছাড়াই জৈবসার আর প্রাকৃতিক উপায়ে পরিচর্যা ও নিয়মিত পানি দেয়ায় ফল আসে গাছগুলোতে। গাছ গাছে এখন ছবির মতো ঝুলে আছে পাকা-আধাপাকা মাল্টা। প্রতিটি গাছে ঝুলে আছে অন্তত এক মণ করে মাল্টা। বিক্রির প্রয়োজন না থাকায় পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশী ও স্থানীয় দুস্থ লোকজনের মাঝে এসব মাল্টা বিলিয়ে দিতে পারবেন তারা। গাছে গাছে মাল্টা ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখে স্থানীয়দের অনেকেই অভিভূত হচ্ছেন। চারা গাছ কিংবা মাল্টার কলম সংগ্রহ করতে চাচ্ছেন অনেকেই। দেখভালের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক আরিফুর রহমান জানান, জলপাই, জাম্বুরা, থাই জাম্বুরা, কামরাঙা, বেরাকাটা লেবু, বেরাকাটা পেয়ারা, পার্সিমন, রাম্বুটান, খাটো জাতের থাই নারিকেলসহ নানা জাতের দেশী-বিদেশী ফল গাছ রয়েছে তাদের ওই বাগান বাড়িতে। রয়েছে রেডলেডি জাতের পেঁপে, লাউসহ সবজির বাগানও। নানা জাতের গোলাপ, রজনীগন্ধা, কামিনী, জবা, জিনিয়া, আলমন্ডা, প্যারাডাইস, মাধবীলতা, গোল্ডেন শাওয়ার, মেফ্লোয়ার, লিলি, সজনেসহ দেশী-বিদেশী শোভাবর্ধক ও ভেষজ গাছও রয়েছে বাগানে। বাগানে আরও আছে মহাছনক, পালমার, সূর্যডিম, মিসস্পেশাল, পুনাই, পুনাই লাল, ম্যাট্রাস, ম্যাট্রাস তোঁতা, হাঁড়িভাঙ্গা, চিনের কিউজাইসহ নানা জাতের আম গাছ। দেশী-বিদেশী ফুল-ফলের সমারোহে মিজান গার্ডেন নামে ওই বাগান বাড়ি সেজেছে যেন স্বপ্নের মতো। তিনি বলেন, বিক্রির প্রয়োজন না থাকায় পুষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে বাগানের উৎপাদিত মাল্টা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থীসহ দুস্থ কিংবা অসহায় দরিদ্র পরিবারের লোকজনের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হবে। ফরমালিন কিংবা বিষাক্ত কার্বাইডের ভয়ে মানুষ যখন বাজারের ফলমূল কেনায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তখন আমাদের গার্ডেনে উৎপন্ন সার-ওষুধ, হরমোন ও ফরমালিনমুক্ত ফল এবং বিভিন্ন গাছের চারা ও কলম শিশু কিংবা অভাবী পরিবারের লোকজনের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকে বাড়ির আঙিনায় আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, কামরাঙাসহ বিভিন্ন জাতের ফল গাছ রোপণ করে শখ মিটিয়ে থাকলেও ভাল ফলন পাওয়া যাবে না এই ভেবে কয়েক বছর আগেও ফল গাছের বাণিজ্যিক আবাদে হাত বাড়ায়নি কেউ। কিন্তু উপকূলীয় বাউফলে সেই চিন্তাচেতনা এখন অমূলক প্রমাণ হচ্ছে। ধানদী গ্রাামের বশির মাস্টারের বাগান বাড়ি, হারুন মৃধা, শাহনুর বেগম, রহিম মৃধা, মন্নান মাস্টার, রামনগর গ্রামের আউয়াল মাস্টার, জাকির মৃধা, কালাইয়া বন্দরের এএসএম ফিরোজ (জাপানী ফিরোজ), হেনরি, মাইনুল ইসলাম, যৌতা গ্রামের বাবুল উকিল, নওমালা গ্রামের আবু তাহের মিয়া, শহিদুর রহমান তালুকদার, মদনপুরা গ্রামের নজরুল মাস্টার বাড়ির মসজিদ সংলগ্ন বাগান, বিলবিলাস গ্রামের আবুল কালাম (ইমাম), কাগুজিরপুলের উত্তম গাঙ্গুলী, পৌর সদরের সাংবাদিক এমরান হাসান সোহেল, ভরিপাশা গ্রামের জাহানারা ও তানিয়া বেগম, ফিরোজ হাওলাদার, রহমান হাওলাদার, হেলাল হাওলাদার, নাজিরপুরের আলমগীর মিয়া, দাশপাড়ার রিপন, মেহেন্দিপুর গ্রামের আবু প-িত বাড়িসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাল্টা ও কমলালেবুসহ নানা প্রজাতির দেশী-বিদেশী ফলের চাষ হচ্ছে। এরই মধ্যে শৌলা গ্রামের নুরজাহান গার্ডেন ও কর্পূরকাঠি গ্রামের স্বপ্নচূড়া থিম পার্কে সারি সারি গাছে ঝুলছে নাগপুরী, বারি কমলা-১, চায়না, এলাচি, বেড়াকাটাহ বিভিন্ন জাতের কমলালেবু ও মাল্টা। ক্রমাগত আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত ফলের আশায় এখন অনেকেই ঘরের আঙিনায়, পরিত্যক্ত ভিটে-বাড়িসহ বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ধরনের ফলদ গাছের চাষে ঝুঁকছেন। পৌর সদরের বাসাবাড়িতে কেউ কেউ আবার টবে ড্রাগন, মাল্টা, কমলাসহ বিভিন্ন ফল গাছ লাগিয়েছেন। গড়ে তুলছেন ছাদ বাগান।
স্থানীয় পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন সেভ দ্য বার্ড এ্যান্ড বি’র পরিচালনা পরিষদের একজন শামসুননাহার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন আর গাছপালা-বনজঙ্গল কেটে বিনষ্ট করায় দেশী প্রজাতির বিভিন্ন ফল গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পড়ছে বিরূপ প্রভাব। ভুটান, ব্রাজিল, ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন, অস্ট্রেলিয়ায় অধিক পরিমাণে মাল্টা ও কমলা উৎপাদন হয়। সমতলে ৬০ সেন্টিমিটার বর্গাকার বা আয়তাকার গর্ত করে ৪-৫ মিটার দূরত্বে বৈশাখ মাসে চারা বা কলম লাগাতে হয়। মাদা তৈরির করে প্রতি গর্তের মাটির সঙ্গে ১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, সমপরিমাণ এমওপি ও চুন, ৩-৫ কেজি ছাই মিশিয়ে ভরাট করে ১০-১৫ দিন পরে চারা বা কলম লাগাতে হয়। এরপর হালকা সেচ দিতে হয়। আগাছা দমনসহ বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। চারা অবস্থায় মাল্টা ও কমলালেবু গাছের গোড়া থেকে গজানো অতিরিক্ত কুশি বা মাথা এবং মরা ও রোগাক্রান্ত ডাল মাঝে মাঝে ছেটে রাখতে হয়। তিনি আরও জানান, মাল্টা সর্দি জ্বর ও বমি নিবারক হিসেবে ভাল কাজ করে। মাল্টা কিংবা কমলার শুকনো ছাল অম্ল ও শারীরিক দুর্বলতা নিরসনে কাজ করে। মাল্টা ও কমলার জ্যাম, জেলি ও জুসের চাহিদা আছে।’
কালিশুরী ডিগ্রী কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা বেগম বলেন, ‘সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় জেলাসহ বিদেশের মাটিতেই কেবল ভাল কমলা কিংবা মাল্টা ফলে এমন ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। বীজ থেকে সরাসরি চারা তৈরি করা যায়। ভাল জাতের মাল্টা বা কমলালেবুর চোখ কলম, পার্শ্বকলম ও ১০-১২ মাস বয়সের চারা বাডিং ও গ্রাফটিংয়ের জন্য আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করা ভাল। সোজা ও ভাল বৃদ্ধি সম্পন্ন তরতাজা চারা অথবা কলম বেছে নিয়ে রোপণ করা উচিত। দেশী প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় ফল গাছের পাশাপাশি মিজান গার্ডেনে মাল্টার মতো পুষ্টিমান সম্পন্ন পরিবেশবান্ধব ফল গাছের পরিকল্পিত বনায়ন করা জরুরী।’
বাউফলের সাবেক উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আরাফাত হোসাইন বলেন, ‘মাল্টা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় ফল। উপকূলীয় বাউফলের বিভিন্ন এলাকায়ও এখন কমবেশি মাল্টা ও কমলার চাষ হচ্ছে। মিজান গার্ডেনে মাল্টার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে অভিভূত হবেন যে কেউ। পুষ্টির চাহিদা পূরণে অন্য পেশার পাশাপাশি শিক্ষিত লোকজনের এ ধরনের ফল চাষে এগিয়ে আসা উচিত।’