ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভেদ সামাল দিতে পারছে না ক্ষমতাসীন দল

জেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি, আওয়ামী লীগে উদ্বেগ

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

জেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি, আওয়ামী লীগে উদ্বেগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকার শক্তিশালী হলেও দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, দ্বন্দ্ব-বিভেদ কিছুতেই সামাল দিতে পারছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সর্বত্র কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে দলটিতে। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে (নাসিক) বিবদমান দু’গ্রুপকে সামাল দিতে গলদঘর্ম অবস্থার মধ্যেই আসন্ন জেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে দলটির হাইকমান্ডকে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা আর বহিষ্কারের হুমকিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২২ জেলা পরিষদেই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এখন আওয়ামী লীগই। বিএনপি-জামায়াত এই নির্বাচনে না থাকলেও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর এই আধিক্য ও অনড় অবস্থান ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সামাল দিতে চেষ্টা করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ১৩ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, মুখে কেন্দ্রীয় নেতারা এমন কথা বললেও বাস্তবতা ঠিক উল্টো। জেলাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের কেন্দ্র থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিলেও বেশিরভাগ স্থানেই জেলার সভাপতি, সাধারণ-সম্পাদক কিংবা স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিরা তা মেনে নিতে পারেননি। বেশিরভাগ স্থানেই জেলার নেতা ও এমপির পরোক্ষ মদদে দল মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। জেলার বড় বড় দলীয় নেতাদের গোপন সমর্থন থাকায় অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থীই তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। যদিও একক প্রার্থী থাকায় ১২ জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। কোন্দল-বিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের মত হচ্ছে, সব জেলা পরিষদেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় অনেক জেলা পরিষদেই নির্বাচন হবে। তবে তারা নিশ্চিত, ৬১ জেলা পরিষদেই আওয়ামী লীগই বিজয়ী হবে। কারণ, বিদ্রোহী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তবে শেষদিন পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থীদের বুঝিয়ে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তারা। এ ব্যাপারে জেলার নেতাদের অভিযোগ, বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থীকে সামাল দেয়া এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল থেকে বহিষ্কারের পরও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারী বিদ্রোহী প্রার্থীকে ক্ষমা করে পুনরায় দলে ফিরিয়ে নেয়ার ফলেই দলে চেন অব কমান্ড দিনে দিনে ভেঙ্গে যেতে বসেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনে করছেন, হুমকিধমকি দেয়া হলেও বাস্তবে তাদের কিছুই হবে না, এ কারণেই তারা কোন সিদ্ধান্ত মানতে চাইছে না। বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে আগে কেন্দ্রীয়ভাবে কঠোর অবস্থান নেয়া হলে নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করতে কোন নেতাই বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সাহস পেত না। তাই কঠোরহস্তে বিদ্রোহীদের এখনই দমন করতে না পারলে আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের মাসুল গুনতে হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন তৃণমূলের নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন এখনও যাচাই-বাছাই এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় রয়েছে। এই সময় পর্যন্ত কেন্দ্র অপেক্ষা করবে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হবে। এরপরও যদি কেউ দল সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। অতীতের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারীকে কোনই ক্ষমা করা হবে না। আর দল সমর্থিত প্রার্থীর বিপক্ষে জেলার নেতা ও দলীয় জনপ্রতিনিধিরা অবস্থান নিলে তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ৬১ জেলাতেই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকের একটি তালিকা গোপনে সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও দলটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দলের তৃণমূল মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ শুক্রবার জনকণ্ঠকে বলেন, এখনও যাচাই-বাছাই এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় রয়েছে। আমরা এ পর্যন্ত অপেক্ষা করব। পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সারাদেশে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬১ জেলা পরিষদের মধ্যে কমপক্ষে ২২টিতেই এক বা একাধিক আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই নির্বাচনকে ঘিরে ওই সব জেলায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্ব নতুন করে জেঁকে বসেছে। অন্য দলগুলো এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন দলটির একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী। মন্ত্রী-এমপির পরিবারের সদস্য কিংবা নিকটাত্মীয়, বিভিন্ন জেলার সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী লীদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এমনকি সহযোগী সংগঠনের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদকও বিদ্রোহী প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন। জেলার প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের দলীয় সমর্থন দেয়া হলেও বিদ্রোহী প্রার্থিতা কেন? এমন প্রশ্ন বেশ কয়েকটি জেলার নেতা ও মনোনয়ন পাওয়া চেয়ারম্যান প্রার্থীকে করা হলে তাদের বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে অভিন্ন অভিযোগ। তাদের মতে, যুগের পর যুগ দলের শীর্ষ পদ ধরে রাখা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কিংবা মন্ত্রী-এমপিরা নিজের বা পরিবারের কাউকেই নেতৃত্বে আসতে দিতে চান না। মন্ত্রী-এমপি কিংবা জেলার শীর্ষ নেতাদের বলয়ের বাইরে যাকেই জেলা পরিষদে দলীয় সমর্থন দেয়া হয়েছে সেখানেই ওইসব নেতার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে। তাদের অভিযোগ, জেলার সকল নির্বাচিত দলীয় জনপ্রতিনিধিকে হুমকি দিয়ে দল মনোনীত প্রার্থীর পরিবর্তে বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার জন্য নানা ধরনের চাপ দেয়া হচ্ছে। মন্ত্রী ও এমপিদের দলের বাইরে নিজস্ব বাহিনী তৈরি করা, দলীয় নেতাকর্মীকে উপেক্ষা করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তৃণমূল সম্মেলনে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে বসানোর চেষ্টা প্রভৃতি কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাবনা জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রেজাউল রহিম। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের মেয়ে ও জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মাহজেবিন শিরিন। এর বাইরে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বর্তমান জেলা পরিষদের প্রশাসক এম সাইদুল হক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন। জেলার ত্যাগী নেতাদের অভিযোগ, মন্ত্রী শামসুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা সব পদ আগেই দখল করে রয়েছেন, এখন জেলা পরিষদও নিজের পরিবারের দখলে নিতে চাইছেন। এভাবে একটি দল চলতে পারে না। শুধু জেলা পরিষদেই নয়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার প্রবণতা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। এ কারণে প্রায় প্রতিটি জেলাতেই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ এখন বহুধা বিভক্ত। অনেক স্থানেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকের প্রাণঘাতী সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন দলের নেতাকর্মীর মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এতদিন দ্বন্দ্ব-কোন্দল কিছুটা মাথাগুঁজে থাকলেও জেলা পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিদ্রোহীরা সব আওয়ামী লীগের হলেও এ নিয়ে দলের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব-বিভাগ সৃষ্টি হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলেও অনেকেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৬১ জেলায় অনুষ্ঠেয় নির্দলীয় এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১৯০ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সাধারণ সদস্য পদে ৩ হাজার ৫৬১ এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ৮৯৫ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বরিশালে প্রার্থী পরিবর্তন ॥ গত ২৫ নবেম্বর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে দলীয় সমর্থন দিয়েছিল খান আলতাফ হোসেনকে। কিন্তু শুক্রবার সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে খান আলতাফ হোসেনের পরিবর্তে মইদুল ইসলামকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শুক্রবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান দলটির কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।
×