ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পাশে দাঁড়িয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর

অদম্য ফাতেমা

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ১৮:৫৯, ১৫ মে ২০২৫

অদম্য ফাতেমা

চাকরিহীন-বেকার; দুই সন্তানকে নিয়ে হতাশায় ডুবে যাওয়া ফাতেমা আজাদের মনে হয়েছিল অনার্স মাস্টার্সের সার্টিফিকেটগুলো ছিঁড়ে ফেলবেন। কিন্তু শৈশবে তাকে ঘিরে বাবা-মায়ের স্বপ্ন আর স্বামীর প্রেরণা তাকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের সবজি-ফলের আচারসহ অর্ধশতাধিক খাদ্যপণ্যের উৎপাদন করে প্রতি মাসে তিনি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন। অনলাইন থেকে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে একটি আউটলেটও করেছেন।
এই ফাতেমার সংগ্রামের সারথী হয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। শুধু ফাতেমা নয় এমন অসংখ্য উদ্যোক্তাকে ‘অন দ্য জব’ প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণপরবর্তী সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাচ্ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি।
সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলতে চাওয়া ফাতেমা আজাদ এখন ‘সনদ বিতরণ’ করেন
যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের বাসিন্দা ফাতেমা আজাদের জন্ম যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার লাউজানি গ্রামে নিম্ন আয়ের একটি পরিবারে। বাবা ফজলুল হক ক্ষুদ্র দোকানি। এই পরিবার থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন কেউ দেখেনি। কিন্তু ফাতেমাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল তার বাবা-মায়ের। সেই স্বপ্নকে সঙ্গী করে ঝিকরগাছা থেকেই এসএসসি, এইচএসসি উত্তীর্ণের পর ২০০৬ সালে যশোর সরকারি এমএম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি যশোরের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি শুরু করেন এবং ২০০৮ সালে বিয়ে করেন সহকর্মী আবুল কালাম আজাদকে। বিয়ের পর সন্তান হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর একটি প্রাইভেট স্কুলে জামানত দিয়ে চাকরিতে ঢুকলেও প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রায় ৩০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জামানতের টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এই সময়েই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেন ফাতেমা। চাকরি নেই; বেকার। দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর একার উপার্জনে শহরে জীবন যাপন করা দুরূহ। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে যায় ফাতেমার। হতাশায় অনার্স-মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। এ সময় স্বামী আবুল কালাম আজাদ তার পাশে দাঁড়ান। স্বামীর সাহস এবং বাবা-মায়ের সেই শৈশবের স্বপ্নকে ধারণ করে নিজেই কিছু করার পথ খুঁজতে থাকেন ফাতেমা। এরই মধ্যে করোনা মহামারি আকার ধারণ করে। রান্নার হাত ভালো হওয়ায় অনলাইনে হোমমেইড খাবার সরবরাহের পরিকল্পনা করেন। প্রথম একজন ক্রেতা ১২ প্যাকেট বিরিয়ানির অর্ডার করেন এবং ১২শ’ টাকা অগ্রিম দেন। এই ১২শ’ টাকাকে পুঁজি করেই যাত্রা শুরু ফাতেমার। এ সময় করোনা বিস্তার লাভ করায় হোম মেইড খাবারের চাহিদা বাড়ে। আবার স্বামী ও নিজের পূর্বের চাকরির সূত্র ধরে হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের খাবারের অর্ডার আসতে থাকে। এভাবে অনলাইনে খাদ্যপণ্যের ব্যবসা প্রসার লাভ করায় প্রশিক্ষণেও আগ্রহী হন তিনি।
এ সময় ফাতেমা ফুড, বেকারি এবং কুকিং বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) এর লেভেল ফোর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছেন। সর্বশেষ তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পার্টনার প্রোগ্রামের আওতায় অন দ্য জব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১২ দিনব্যাপী খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসা পরিচালনার প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।
সংগ্রামী উদ্যোক্তা ফাতেমা আজাদ বলেন, ২০০৭ সালে চাকরি শুরুর পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ২০১৯ সালে উদ্যোক্তা হিসেবে খাদ্যপণ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। অনেক দুঃসময় এসেছে; কিন্তু কখনো দমে যাইনি। দুটি সন্তান দেখভাল করার লোক পাইনি। শ্বশুর বাড়ির লোকজন বলেছে, বাপের বাড়ির সহযোগিতা নাও, আর বাপের বাড়ির লোকজন বলেছে, শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতা নাও। এমন পরিস্থিতিতে ছোট্ট সন্তান কাঁধে ঝুলিয়ে বাইক চালিয়ে খাবার ডেলিভারি করেছি।’
ফাতেমা জানান, চলার পথে লোপা মীর্জা, জেসমিন রোজ, মুসলিমা খাতুনসহ অনেকেই নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এখন ফাতেমা ফল-সবিজর ৫০ রকমের আচারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদন করছেন। এর মধ্যে রয়েছে বেগুন, করোলা, গাজর, বরবটিসহ প্রচলিত বিভিন্ন সবজির আচার, আমের আচার, জলপাইয়ের আচার, বরই আচার, তেঁতুল আচার, চালতার আচার, বিভিন্ন ধরনের মিক্সচার আচার, বোম্বাই মরিচের আচার, রসুনের মিক্সচার আচার, বিভিন্ন ফলের আচার, হোমমেইড চকোলেট, বিভিন্ন ধরনের কেক, বিস্কুট, বেকারি পণ্য। এর বাইরে হোমমেইড খাবার, বিভিন্ন ধরনের বিরিয়ানি, চুইঝালের মাংস, কাবাব, পিৎজা, বার্গার, ডেজার্ট, ফ্রোজেন আইটেম উৎপাদন ও বিক্রি করছেন। প্রতি মাসে গড়ে তার ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা উপার্জন হয়। এ ছাড়া ট্রেইনার হিসেবেও কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিতরণ করছেন ‘সনদ’ও। ফাতেমা আজাদ আরও জানান, সংগ্রামের দীর্ঘ পথে যুব উন্নয়ন পুরস্কার, জয়িতা সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছেন। সর্বশেষ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া সড়কে মাহমুদুর রহমান স্কুল মোড়ে ‘আলোর সঞ্চয় এগ্রো ফুড অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ নামে আউটলেট দিয়েছেন। আর ‘আলোর সঞ্চয় এগ্রো ফুড’ নামে ফেসবুক পেজ থেকেও অনলাইনে খাবার সরবরাহ করছেন।  ফাতেমা আজাদের স্বামী বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ফাতেমা এক সময় হতাশ হয়ে পড়েছিল। সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল। তখন তাকে উদ্বুদ্ধ করেছি। তার মধ্যে অদম্য শক্তি আছে। সেই শক্তির বলে এখন সে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

প্যানেল

×