
ছবি: প্রতীকী
বিমান দুর্ঘটনায় আক্রান্ত অনেক রোগী শরীরের বিভিন্ন অংশে পুড়ে যেতে পারেন। পুড়ে যাওয়া এক ধরনের গুরুতর আঘাত যা দ্রুত ও সঠিকভাবে চিকিৎসা না করলে জীবনহানির ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এ ধরনের রোগীর যত্ন নেওয়ার সময় ধৈর্য, সতর্কতা ও সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে, রোগী নিরাপদ স্থানে আছে কিনা। দুর্ঘটনার পর অনেক সময় চারপাশে আগুন থাকতে পারে, ধোঁয়া বা গরম ধাতব বস্তু থাকতে পারে, যা রোগীর জন্য আরও বিপদজনক হতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনতে হবে।
পরবর্তী ধাপে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি সে জ্ঞানহীন থাকে বা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তবে প্রথমেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিশ্চিত করতে হবে। অনেক সময় পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ধোঁয়ায় শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে রোগীর শ্বাসরোধ হতে পারে। তাই প্রয়োজন হলে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে এবং চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
পোড়া অংশে কোনভাবেই ঠান্ডা পানি সরাসরি ঢালা যাবে না যদি পোড়া গভীর বা তৃতীয় স্তরের হয়। তবে হালকা পোড়ায় ঠান্ডা পানি ১০ থেকে ১৫ মিনিট ঢাললে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায় এবং পোড়ার ক্ষতি কিছুটা কমে। যেকোন অবস্থায় বরফ ব্যবহার করা যাবে না, কারণ এটি ত্বকে আরও ক্ষতি করতে পারে।
পোড়া অংশে যদি পোশাক লেগে যায়, তাহলে সেটা টেনে খুলতে যাওয়া উচিত নয়। এতে চামড়া উঠে যেতে পারে এবং ক্ষত আরও বেড়ে যেতে পারে। পোশাক যদি ঢিলা হয় এবং সহজে খোলা যায়, তবেই তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এরপর পরিষ্কার ও নরম কাপড় দিয়ে জায়গাটি ঢেকে রাখতে হবে যেন ধুলাবালি না লাগে এবং সংক্রমণ না ঘটে।
রোগীর ব্যথা কমানোর জন্য পেইন কিলার দেওয়া যেতে পারে, তবে সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হওয়া উচিত। নিজ থেকে ওষুধ খাওয়ানো বিপজ্জনক হতে পারে, বিশেষ করে যদি রোগী অজ্ঞান থাকে বা গিলে খেতে না পারে। এছাড়া, রোগীর শরীরে তরল পদার্থের ঘাটতি হয় বলে স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে, যা হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দেওয়া ভালো।
পোড়া রোগীর জন্য ইনফেকশন বড় একটা ঝুঁকি। তাই সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তার শরীরের যত্ন নেওয়ার সময় হাত ধুয়ে নিতে হবে এবং জীবাণুমুক্ত কাপড় ব্যবহার করতে হবে। পোড়া অংশে কোন প্রকার ঘরোয়া মলম, তেল বা মাখন ব্যবহার করা যাবে না, কারণ এতে ইনফেকশনের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
রোগী যদি অনেকটা অংশে পুড়ে যায়, তাহলে তাকে বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অনেক বড় হাসপাতালে এখন বার্ন ইউনিট রয়েছে যেখানে পোড়া রোগীর বিশেষায়িত চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে তার শরীরের তরল ভারসাম্য, পুষ্টি, ইনফেকশন প্রতিরোধ এবং মানসিক অবস্থা সবকিছু বিবেচনা করে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পুড়ে যাওয়া রোগীর যত্ন কেবল শারীরিক চিকিৎসাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তার মানসিক যত্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিমান দুর্ঘটনার মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অনেক রোগীর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। তারা আতঙ্কে ভোগে, ঘুমাতে পারে না, দুঃস্বপ্ন দেখে, এমনকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই তাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য পরিবারের সহানুভূতি, মানসিক সাপোর্ট এবং প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া। অনেক সময় মানুষ ভয়ে দেরি করে, এতে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তাই যেকোনো পুড়ে যাওয়া রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও যত্ন দেওয়া উচিত।
সঠিক যত্ন ও চিকিৎসার মাধ্যমে পুড়ে যাওয়া রোগীরা ধীরে ধীরে সুস্থ হতে পারে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। এজন্য দরকার সময়, সহানুভূতি, দক্ষতা এবং ধৈর্য। বিমান দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া একজন মানুষ শুধু একজন রোগী নয়, তিনি একটি পরিবারের সদস্য, একটি সমাজের অংশ। তাই তার প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ আমাদের সবার কর্তব্য।
এম.কে.