
ছবি: প্রতীকী
শিশুর জন্মের পর থেকেই তার মানসিক বিকাশে পরিবেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘর, পরিবার, বিশেষ করে মা-বাবার সম্পর্ক একটি শিশুর নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তির প্রধান উৎস। কিন্তু যখন সেই সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়, ঝগড়াঝাঁটি, উচ্চস্বরে কথা বলা কিংবা একে অপরকে দোষারোপ করা হয়, তখন সেই নিরাপত্তাবোধ ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধরনের পারিবারিক পরিবেশ শিশুর ঘুম, মস্তিষ্কের গঠন এবং মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
একটি শিশু যখন দেখে তার মা-বাবা প্রায়ই ঝগড়া করছেন, তখন তার মনে ভয়, দুশ্চিন্তা এবং অনিরাপত্তার বোধ তৈরি হয়। শিশুরা বড়দের মতো বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারে না। তারা বোঝে না ঝগড়ার কারণ কী বা এটা কতটুকু স্বাভাবিক। বরং তারা মনে করে কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে, হয়তো মা-বাবা আলাদা হয়ে যাবে, হয়তো তাকে ছেড়ে চলে যাবে। এই ধরনের ভয় তাদের মনকে অসচেতনভাবে আঘাত করে এবং দিনের পর দিন এমন অবস্থা চলতে থাকলে শিশু মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
শিশুর ঘুমে এর প্রভাব পড়ে ভয়ংকরভাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, মা-বাবার ঝগড়ার শব্দ, চিৎকার কিংবা মানসিক টানাপোড়েন শিশুর ঘুমের গুণগতমান নষ্ট করে দেয়। অনেক শিশু রাতে ঘুম ভেঙে কাঁদে, দুঃস্বপ্ন দেখে বা রাতে একা ঘুমাতে ভয় পায়। দিনের বেলায় তাদের মধ্যে ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব, এবং খিটখিটে মেজাজ দেখা দেয়। একটি শিশু ঠিকমতো না ঘুমালে তার মস্তিষ্কে যে স্বাভাবিক গঠন হওয়ার কথা ছিল, তা ব্যাহত হয়।
বিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুদের মস্তিষ্ক গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর। এই সময়ে ভালো ঘুম, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরাপত্তাবোধ প্রয়োজন। কিন্তু মা-বাবার মধ্যে ক্রমাগত ঝগড়া থাকলে শিশুর মস্তিষ্কে কর্টিসল নামক একটি হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোন উদ্বেগের সঙ্গে সম্পর্কিত। কর্টিসলের পরিমাণ দীর্ঘদিন ধরে বেশি থাকলে তা শিশুর ব্রেইনের উন্নয়ন ব্যাহত করে এবং ভবিষ্যতে তার মধ্যে উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, এবং আচরণগত সমস্যা তৈরি করে।
আরেকটি দিক হলো, শিশুরা মা-বাবার আচরণ থেকে শিখে। যদি তারা দেখে, ছোটখাটো বিষয়ে বড়রা চিৎকার করছে, সহনশীলতার অভাব দেখাচ্ছে, তাহলে তারাও সেই আচরণ নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করে ফেলে। তারা বিশ্বাস করতে শেখে যে সমস্যার সমাধান হয় ঝগড়া করে, উচ্চস্বরে কথা বলে বা অপরকে দোষারোপ করে। ফলে তারা স্কুলে, বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা ভবিষ্যতে দাম্পত্য জীবনে সেই আচরণই দেখায়।
এছাড়া, কিছু শিশু মা-বাবার ঝগড়া দেখে নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করে। বিশেষ করে ছোট শিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। তারা মনে করে, হয়তো তাদের জন্যই বাবা-মা ঝগড়া করছে। এই আত্মদোষবোধ থেকে তাদের মধ্যে অবসাদ, আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং একাকীত্ব তৈরি হয়, যা পরবর্তী জীবনে বড় ধরনের মানসিক সমস্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সমাধানের জন্য মা-বাবার সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। প্রতিটি পরিবারেই মতবিরোধ হতে পারে, কিন্তু তা শিশুদের সামনে নয়। শিশুরা যা দেখে, সেটাই শেখে—এই সত্যটি মাথায় রেখে মা-বাবার উচিত এমন আচরণ করা যা থেকে শিশুরা সহনশীলতা, পারস্পরিক সম্মান ও শান্তিপূর্ণ সমস্যা সমাধান শেখে। শিশুর মানসিক বিকাশ, ঘুম এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল, ভালোবাসাপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ সবচেয়ে প্রয়োজন।
মা-বাবার ঝগড়া শুধু একটি পারিবারিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা একটি শিশুর মস্তিষ্ক, মন এবং ঘুমকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই শিশুদের সুস্থ বিকাশের কথা চিন্তা করে মা-বাবার উচিত নিজেদের আচরণের প্রতি সচেতন হওয়া এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা যা শিশুকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এম.কে.