
ছবি: প্রতীকী
সকালের শুরুটা আমাদের সারা দিনের মেজাজ, শক্তি এবং মনোভাবকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এমন অনেক সকাল আসে, যখন ঘুম থেকে উঠে মনে হয় সব কিছু ধোঁয়াটে, নিরর্থক, নিষ্প্রাণ। এমনটা হলে আপনি একা নন। এই অনুভূতি খুব স্বাভাবিক, এবং বহু মানুষ প্রতিদিন এর মুখোমুখি হন। তবে এই অনুভূতির সঙ্গে দীর্ঘ সময় লড়াই করলে সেটি বিষণ্ণতার (depression) লক্ষণও হতে পারে। কিন্তু তার আগেই, নিজেকে একটু বোঝা জরুরি।
সকালে এমন অনুভূতির মূল কারণ হতে পারে মানসিক ক্লান্তি, অনিশ্চয়তা, ভয়ের চাপ কিংবা অতিরিক্ত প্রত্যাশা। আজকাল আমরা সবাই খুব ব্যস্ত, অথচ ভিতরে ভিতরে ভীষণ একা। চারপাশে অনেক কিছু ঘটছে, কিন্তু নিজের জীবনে হয়তো যেন কিছুই ঘটছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যদের জীবনের চাকচিক্য দেখে নিজের জীবনকে মূল্যহীন মনে হতে পারে। অথচ, এসব তুলনার কোনো বাস্তব মানে নেই। প্রতিটি মানুষের যাত্রা আলাদা এবং প্রতিটি সকাল একটি নতুন সুযোগ— যদিও সবসময় সেটা আমরা অনুভব করতে পারি না।
মন খারাপের সকালে প্রথম যেটা দরকার, তা হলো নিজের প্রতি একটু সহানুভূতি। নিজেকে তাড়াহুড়ো করে সামলে তোলার দরকার নেই। বরং নিজেকে জিজ্ঞেস করুন— আজকের সকালে আপনার সবচেয়ে বেশি কী দরকার? ঘুম? একটু নিরিবিলি সময়? কোনো কিছু না করেও কিছুক্ষণ বসে থাকা? এমনকি এই প্রশ্ন করার মধ্যেই একটা আত্ম-সহানুভূতির অনুভব থাকে, যা ধীরে ধীরে মনের ভার হালকা করে।
অনেক সময় আমরা ভাবি, সব সময় আমাদের প্রোডাকটিভ থাকতে হবে, সব সময় কিছু করে যেতে হবে। এই ভাবনা থেকেই আসে ক্লান্তি, অবসাদ, চাপ। কিন্তু মানবমন এমন না যে, তাকে ২৪ ঘণ্টা কার্যক্ষম রাখতে হবে। মন মাঝে মাঝে চুপচাপ বসে থাকতে চায়, কেবল প্রকৃতি দেখতে চায়, পুরনো গান শুনতে চায় বা শৈশবের কথা ভাবতে চায়। এসব চাওয়া যদি দমন করে রাখি, তাহলে সকালে উঠে মনে হবেই— "কিছু ভালো লাগছে না।"
এই অনুভূতিকে বোঝার একটি উপায় হলো, একে প্রতিপক্ষ না বানিয়ে বন্ধুর মতো কাছে টেনে নেওয়া। মনে রাখবেন, আপনি যেটা অনুভব করছেন, সেটা আপনার কোনো ব্যর্থতা নয়। বরং এটা আপনার মানসিক স্বাস্থ্য একটি বার্তা পাঠাচ্ছে— আপনাকে একটু থামতে হবে, নিজের কথা শুনতে হবে। হয়তো আপনি অনেকদিন ধরে শুধু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, অথচ নিজের কোনো ইচ্ছের কথা শোনেননি। হয়তো আপনি কারও জন্য অনেক কিছু করছেন, কিন্তু আপনার নিজের জন্য কিছুই করছেন না। এ অবস্থায় "ভালো না লাগা" একপ্রকার আত্মার কান্না, যার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত।
কী করা যেতে পারে? ছোট কিছু অভ্যাস এই অনুভূতির ভার অনেকটা হালকা করে দিতে পারে। যেমন, সকালে ঘুম থেকে উঠে ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে শুধু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দেওয়া। আপনি চাইলে এই সময়টায় বলতে পারেন— “আমি আছি, আমি টিকে আছি, আমি চেষ্টা করছি।” আবার, নিজের জন্য একটি সুন্দর কাপ চা বা কফি বানানো, পছন্দের কোনো পুরনো গান শোনা, জানালা খুলে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা— এসব ছোট জিনিস মানসিক আরাম দিতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কারও সঙ্গে কথা বলা। সব সময় গভীর কথা না হলেও চলে। শুধু ‘আজ সকালটা কেমন যাচ্ছে’ বলা বা কারও সঙ্গে হালকা মজার গল্প করাও মন হালকা করতে পারে। কোনো কাছের বন্ধু, পরিবারের সদস্য, এমনকি সহকর্মী যেকোনো কারো সঙ্গে কথা বলা অনেক সময় ভিতরের ভার কমিয়ে দেয়।
যারা নিয়মিত এই অনুভূতির মুখোমুখি হন, তাদের জন্য প্রয়োজন কিছু সচেতন বদল। যেমন: প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট হাঁটা, শরীরচর্চা বা ধ্যান করা, ঘুমের সময় ঠিক রাখা, দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় শুধু নিজের জন্য বরাদ্দ রাখা— এসব অভ্যাস ধীরে ধীরে মনের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। খাবারের দিকেও নজর দিন, কারণ খালি পেটে বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মন খারাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে যদি এই ‘ভালো না লাগা’ দীর্ঘস্থায়ী হয়, প্রতিদিনের কাজে বাধা দেয়, বা মনে হয় জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলেছেন, তাহলে দেরি না করে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। ঠিক যেমন জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যাই, মন অসুস্থ হলে তারও চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। দুর্বলতা নয়, বরং নিজের জন্য সহানুভূতি ও দায়িত্বশীলতারই প্রকাশ হলো কাউন্সেলিং নেওয়া।
মনে রাখুন, সকালের মন খারাপ মানেই খারাপ দিন না। মন খারাপের মধ্যেও জীবনের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে, যদি আপনি সেটাকে উপলব্ধি করার সুযোগ দেন। আপনি যে আজ সকালে ঠিকমতো ঘুম থেকে উঠেছেন, এটাই অনেক বড় সাফল্য। কারণ হাজারো মানুষের পক্ষে সেটাও সম্ভব হয় না। জীবন সব সময় একরকম যায় না, এবং আপনার মনের এই অস্থিরতা-অস্বস্তিও চিরস্থায়ী না। ধৈর্য ধরুন, একটু থামুন, নিজের কাঁধে হাত রাখুন। আপনার জন্য ভালো সময় অপেক্ষা করছে। হয়তো ঠিক পরবর্তী সকালেই।
এম.কে.