ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য

রেজা ফারুক

প্রকাশিত: ০০:৩৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

টাঙ্গাইল শাড়ির ঐতিহ্য

অনুপম টাঙ্গাইল শাড়ির অভিযোজন

একটি জাতির সাংস্কৃতিক অধিকার-ওই জাতিকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা উঁচু করে পথ চলতে অবিশ্রাম সহায়তা করে। জাতি হিসেবে বাঙালিও সেই সত্তাকে ধারণ করে হাজার বছর ধরে পথ চলছে। এই চলতি পথে যুগে যুগে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পালক ভরেছে উজ্জ্বল মুকুটে। সেই গৌরবময় পালকেরই একটি হলো অনুপম টাঙ্গাইল শাড়ির অভিযোজন।
গত প্রায় আড়াই শতাব্দীকাল ধরে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ারের পাথবাইলের বিনিদ্র গ্রামে অসংখ্য বসাক পরিবার হস্তচালিত তাঁতে সুতি ও সিল্কের সুতোয় এক প্রকার চমৎকার নকশাদার শাড়ি বুনন করে বাজারজাতের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যা এক সময় টাঙ্গাইলের শাড়ি হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে। টাঙ্গাইলের এই তাঁতের শাড়ি শুরুতেই সারাদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়।
সেই থেকে অদ্যাবধি টাঙ্গাইলের শাড়ি স্বকীয় ঐতিহ্য ধারণ করে নিজস্ব এক সাংস্কৃতিক রূপরেখা এঁকে নেয় অবয়বে। চমৎকার ফ্যাশনের ডিজাইন, মান, রঙ ও গুণসম্পন্ন এবং সহনীয় দামের এই টাঙ্গাইল বাঙালি রমণীদের কাছে যুগ যুগ ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে।
এই শাড়ি তৎকালীন ভারতবর্ষের এক অমিয় সাংস্কৃতিক সম্পদে পরিগণিত হয়। অতঃপর ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর এই টাঙ্গাইল শাড়ি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ছন্দ কেটে যায়। টাঙ্গাইলের বসাক পরিবারের অনেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান তারাই নতুন উদ্যমে টাঙ্গাইল শাড়ি প্রস্তুত বাজারজাত করার বিষয়ে অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এই পথচলায় আসে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং অব্যবহিত পরে যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাঙালি পায় স্বাধীন একং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন সবকিছু নতুন করে সূচনার পথে পা বাড়ায়। এই শুভ সূচনায় শামিল হয় টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পও।   দেশের তাঁতশিল্পে জোয়ার বইয়ে দেওয়ার এক উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে এসে টাঙ্গাইল শাড়ির হৃতগৌরব সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে ঢাকার বেইলি রোডে স্থাপিত হয় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। যার স্বত্বাধিকারী বিশিষ্ট সংস্কৃতিমনা মানুষ মুনিরা এমদাদ।

তাঁরই নেতৃত্বে টাঙ্গাইল শাড়ি একটা আলাদা ইমেজ সৃষ্টি করে ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা ও উপজেলা শহরে। টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হতে থাকে। টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি টাঙ্গাইল শাড়ি প্রস্তুত ও বিপণনকারীদের মধ্যেও উন্নত জীবনযাপনের ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ির নকশা ও প্যাটার্নেও এসেছে রূপবদল। বাঙালি সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে এই শাড়ির চাহিদা দিন দিন যেন আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারাদেশে বুটিক শপে ঘটে এক ঐতিহাসিক বিপ্লব। ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় রেখে অসংখ্য ফ্যাশন হাউস গড়ে ওঠে রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডসহ বেশকিছু স্থানে। যা ক্রমশ: ঢাকার অভিজাত এলাকা ছাড়িয়ে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ জেলা শহরেও ছড়িয়ে পড়ে।

এই ফ্যাশন হাউসগুলোতেও টাঙ্গাইল শাড়ি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থান দখল করে নেয়। মধ্যবিত্ত নারীদের প্রিয় শাড়ি হয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি। ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, ভ্যালেন্টাইনসহ বিভিন্ন স্পেশাল দিনে টাঙ্গাইল শাড়ি বাঙালি নারীর মন জয় করে এক অনিন্দ্য উপাখ্যান সৃষ্টি করে।
দীর্ঘ প্রায় আড়াই শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের টাঙ্গাইল শাড়ি নিজস্বতা গুণে আজ হয়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ শাড়িকে ঘিরেই চলছে এখন তুমুল আলোচনা। সম্প্রতি ভারত সরকার কর্তৃক টাঙ্গাইল শাড়ি নিজেদের ভৌগোলিক পণ্য হিসেবে গণ্য করে সনদ প্রদান করে। এতে টাঙ্গাইল শাড়ির আদি প্রস্তুত স্থলের মানুষসহ সারাদেশই ভারতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

ইতিহাসের ধারা বরিষণে সিক্ত এই টাঙ্গাইল শাড়ি তার পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির অনবদ্য উপকরণ হিসেবে আবহমান কালের হাইওয়েতে ছন্দময় গতিতে এগিয়ে যাবে এটাই সর্বমহলের আকাক্সক্ষা। প্রায় দুইশত বছরের ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে টাঙ্গাইলের হস্তচালিত তাঁতে বোনা শাড়ির রয়েছে নিজস্ব এক অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্য। যে বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্যময়তার গুণে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি নারীর অবস্থান রয়েছে।

সেখানেই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ সমাদৃত হয়ে স্বকীয়তাকে মেলে ধরেছে। বিগত দুই শত বছর ধরে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার থানাধীন পাথরাইলের চন্ডিসহ অনেক স্থানে টাঙ্গাইল শাড়ি বুননের ক্ষেত্র তৈরি হয়। বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ তাঁত শিল্পী টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন ও বিপণন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় এবং ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ও তার আগে-পরে টাঙ্গাইল থেকে অনেক বসাক পরিবার পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার ফুলিয়া এবং বর্ধমানের সমুদ্রগড় ও ধাত্রী গ্রামে বসতি স্থাপন করে তাদের পূর্বপেশা টাঙ্গাইল শাড়ি বুননেই যুক্ত হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।

সেই সুবাদেই যদি টাঙ্গাইল শাড়ি ভারত তার নিজস্ব সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়, সেটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং সম্মানের পর্যায়েও পড়ে না। বাংলাদেশের ঢাকাই মসলিন, নারায়ণগঞ্জের জামদানি এবং টাঙ্গাইলের জগৎ বিখ্যাত তাঁতের শাড়ি শুধুই বাংলাদেশের ঐতিহ্য- বাংলাদেশের অনন্তকালীন সংস্কৃতির অংশ।

×