শ্যামলীর টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার
জন্ম বরিশালে হলেও বেড়ে ওঠা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ছোটবেলার বেশিরভাগ সময়টা কেটেছে পাবনা-রাজশাহী অঞ্চলে। পরে রাজধানীতেই শেষ করেছেন পড়ালেখা। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় বরং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকেই পড়ালেখা করে মানবসেবায় নিজেকে ব্রতী করে পরিচিতি পেয়েছেন মানবিক ডাক্তার হিসেবে। মহামারী করোনাকালীন দুই বছর এমন একদিন নেই যিনি কর্মস্থলে যাননি।
এমন একটা ঘণ্টা নেই যখন নিজের মুঠোফোনটা বন্ধ রেখেছেন। কারও হাসপাতালে সিট প্রয়োজন, কারও আইসিইউ লাগবে, কারও বা আবার প্লাটিলেট। সব এক হাতে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি কোনো কোনো রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে আসার জন্য এম্বুলেন্সটাও পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছেন। টিকাদান কর্মসূচির শুরু থেকে এমন কোনো গণমাধ্যমকর্মী নেই যে তার কাছে গিয়েছে অথচ টিকা না ফিরেছে। আর এভাবেই তিনি হয়েছে উঠেছেন ‘মানবিক ডাক্তার’। বলা হচ্ছে শ্যামলির ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তারের কথা।
একজন নারী হয়ে পাহাড় সমান বাধা পেরিয়ে সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করেও নিজেকে এক মুহূর্তের জন্যও জনবিচ্ছিন্ন করেননি। এই চলার গল্প জনকণ্ঠের কাছে বলতে গিয়ে তাই কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পরলেন তিনি। বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণের সময় নিজেকে নিয়ে নিজে যতটা না আতংকিত থাকতাম তার চাইতে বেশি আতংকে থাকতো আমার পরিবার। আমাকে যারা চিনেন তারা জানেন, রোগীর প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে কখনো পিছপা হয়নি আমি। তাই আমার সংক্রমণের শঙ্কাটাই করতো সবাই। কিন্তু আমার চোখের সামনে তখন সারি সারি রোগী।
সিট না থাকার কারণে কাউকে ভর্তি করতে পারছি না। কারও আবার অক্সিজেন লেভেল এত নিচে নেমে গিয়েছে যে আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়া বাঁচানো যাবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে হাসপাতালে কোনো আইসিইউ সিট ফাঁকা নেই। তখন অন্য হাসপাতালগুলোতে হন্যে হয়ে খুঁজেছি একটা আইসিইউর ফাঁকা সিট। এভাবে যতটা পেরেছি সংকটকালীন সময়ে রোগীর সেবায় নিয়োজিত থেকেছি। কিভাবে এত মনোবল পেলেন তখন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষের সেবা করার জন্য যদি কেউ একজন মনস্থির করে ফেলে তাহলে কোনো বাধাই তখন তার কাছে আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আমার ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল মানব সেবায় ব্রতী হব। আর একজন চিকিৎসক হওয়ার সুবাধে সেই কাজটাই নির্বিঘ্নে করতে পারছি এর চাইতে আর সুখের কি আছে বলুন।
বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি মোকাবিলার যুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন সম্মুখ সারির যোদ্ধা চিকিৎসকরা। এই কঠিন দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে ছিলেন নারী চিকিৎসকরা। মহামারির মধ্যেও পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসিমুখে সেবা দিয়েছেন যেসব নারী চিকিৎসক তাদের মধ্যে অন্যতম এই মানবিক ডা. আয়েশা আক্তার শিল্পী ২২তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) এর মাধ্যমে সহকারী সার্জন হিসেবে চিকিৎসা পেশায় যোগদান করেন। ছিলেন সরকারি স্বাস্থ্য কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমানে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালে। একজন নারী হিসেবে কিভাবে পথচলার অনুপ্রেরণা পান এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনসহ সবক্ষেত্রেই নারীরা এখন সফলভাবে বিচরণ করছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এই অবস্থানে আমরা এই অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি, এটা একটা বড় ধরনের অর্জন। তবে কিছু বাধা অতীতে যেমন ছিল বর্তমানেও রয়েছে। সেগুলো অতিক্রম করার সক্ষমতাও বেড়েছে এ সময়ের নারীদের। ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সব ধরনের পেশায় পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন নারীরা।
সংসারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কর্মস্থলে সফলও হচ্ছেন তারা। বর্তমানের এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে কারো পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। বাধা ডিঙ্গিয়েই সামনে এগুতে হবে। বর্তমান সময়ে কর্মস্থলের পরিবেশেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে উল্লেখ করে ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারীবান্ধব নীতি এবং পদক্ষেপের কারণে পরিবার ও সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। চিকিৎসা, সাংবাদিকতা, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ পুলিশ প্রশাসনেও নারীরা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে কর্মস্থলে নারী বা পুরুষকে এক কাতারেই বিবেচনা করেন এই চিকিৎসক। বলেন, পেশায় দায়িত্বের জায়গায় নারী-পুরুষ বলে আলাদা থাকা ঠিক নয়।
নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবেই চিকিৎসা সেবাসহ সব ধরনের পেশায় কাজ করতে হবে, অবদান রাখতে হবে দেশ গঠনে। প্রাধান্য দিতে চান পরিবারকেও। বলেন, পরিবার হলো একজন নারীর প্রথম দায়িত্বের জায়গা। কর্মজীবী নারীকে কিন্তু সব দিক সামলাতে হয়, ঘর-সংসার সামলানোর পর তাকে অফিস করতে হচ্ছে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। এজন্য দরকার পুরুষের সহযোগী মনোভাব ও সহযোগিতা। করোনাকালীন সময় ঘরে অসুস্থ বাচ্চা রেখেও চৌদ্দ দিন কোয়ারেন্টিনে থেকে হাসপাতালে রোগীর সেবা করতে হয়েছে। পরিবার থেকে সাপোর্ট পাচ্ছে বা আদায় করে নিচ্ছে।
কারণ কর্মজীবী একজন নারী- চিকিৎসক অথবা সাংবাদিক; কাজের ধরনের কারণে তাকে হয়তো দেরিতে বা অনেক সময় রাত করে অসময়ে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। অথচ পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরাও সেটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করছেন না; বরং মানিয়ে নিচ্ছেন। অনেক পরিবারে এসব দায়িত্ব পালনে পুরুষেরাও সহযোগী মনোভাব দেখাচ্ছে, যা আরও বাড়ানো দরকার।
মানবিক ডাক্তার পরিচিতি পেয়ে আপনার অনুভূতি কি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি আসলে আমার কর্তব্য পালন করছি। আমাকে যারা এই নামে ডাকেন তাদের বেশিরভাগই গণমাধ্যমকর্মী। আর গণমাধ্যমর্কীরাও সম্মুখসারির যোদ্ধা।
তারা সমাজের দর্পণ। তাদের লেখনি ও তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমেই দেশের মানুষ সব খবর পেয়ে থাকে। তাদের সুরক্ষাও জরুরি বিষয়। তাই করোনাকালীন সময়ে অন্যান্য রোগীর পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদেরও আমি সর্বোচ্চ সেবা দিতে চেষ্টা করেছি। এখনো করছি। ভবিষ্যতেও করব। মানবসেবায় নিজেকে যখন নিয়োজিত করেছি তখন বেঁচে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। মানুষজনের ভালোবেসে দেওয়া নাম এ কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়।