প্রাচীন মিসরের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করেছে তাদের মমি। বিশেষ উপায়ে সংরক্ষিত মৃতদেহগুলো মমি নামে পরিচিত। মিসরের পিরামিড এবং এর আশপাশে অসংখ্য মমি করা মৃতদেহ পাওয়া যায়। এগুলো বেশিরভাগই ছিল মিসরের ফারাও অর্থাৎ রাজা, রানী, তাদের বংশের লোকেদের। জানা যায়, সেসময় রাজবংশ এবং উচ্চবংশীয় ছাড়া কারও মৃতদেহ মমি করার অনুমতি ছিল না। এতে করে তাদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণœ হতো। আর এটি বেশ ব্যয়বহুলও ছিল বটে। যা মিসরের সাধারণ জনগণের পক্ষে বহন করাও সম্ভব ছিল না। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় ফারাওদের জীবনযাত্রা ছিল বেশ রহস্যময়। তারা বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। একটি মৃতদেহ যেন পচে-গলে নষ্ট না হয়ে যায় এজন্য মমি করা হয়। এই তথ্য প্রায় সবারই জানা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মমি হচ্ছে অপচনশীল মৃতদেহ। মমি শব্দটি মধ্য যুগের লাতিন শব্দ মুমিইয়া থেকে এসেছে। যা আরবী শব্দ মুমিয়া এবং পারস্য ফার্সী ভাষা মোম থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো বিটুমিন।
অধিকাংশ গবেষকের মতে, মমির উৎপত্তিস্থল হলো প্রাচীন মিসর। তবে জানা যায়, প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতারও এক হাজার বছর পূর্বে উত্তর চিলি এবং দক্ষিণ পেরুর চিনচেরাতে মমির সংস্কৃতি চালু হয়। ওই অঞ্চলের আদিবাসীরা সমুদ্রের মাছ খেয়ে জীবনযাপন করত। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তাদের বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। তাদের সময় থেকেই শুরু হয়েছে মৃতদেহ কবর না দিয়ে মমি করে রাখার ব্যবস্থা। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃতদেহ মমি করার প্রচলন ছিল। ইনকা, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, প্রাচীন ইউরোপিয়ান সভ্যতায়ও মমি করার প্রচলন ছিল। তারা মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে হাজারো বছর ধরে মমি করত।
মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পরও জীবনের অস্তিত্ব থাকে। আর সেজন্য তারা মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়-স্বজনের দেহকে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কবরস্থ করত না। তার বদলে পিরামিডে মমি করে সংরক্ষণ করা হতো মৃতদেহকে। পিরামিডগুলো সাধারণত গড়ে উঠেছিল তৎকালীন ফারাওদের সমাধি সৌধ হিসেবে। শুধু যে পিরামিডের মধ্যেই মমি রাখা হতো তা কিন্তু নয়, কবরও দেয়া হতো। সেক্ষেত্রে মমি করার পর মৃতদেহ কবরে রাখা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে আগে মিসরীয়রা মৃতদেহ গভীর কোন গুহায় কবর দিত। আবার মরুভূমির বালির তাপমাত্রায় অনেক সময় এমনিতেই মমিতে রূপান্তরিত হতো মৃতদেহগুলো।
দ্বিতীয় রাজশাসনের শুরু থেকেই মৃতদেহ মমি করার প্রথা চালু হয়। ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ম্যাকারি ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড একসঙ্গে প্রায় ১১ বছর এই নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় ১৫০০ বছর আগে থেকে মৃতদেহ মমিকরণের প্রথা চালু হয়। মিসরীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগে মৃতদেহ মমি করা ও পিরামিড তৈরির প্রচলন সামাজিক পদমর্যাদা এবং সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
চতুর্থ রাজবংশের আমলে খনিজ দ্রব্য এবং সুগন্ধি তেল দিয়ে মমি সংরক্ষণের প্রথা চালু হয়। তবে এসবের অনেক তথ্যই এখনও উদ্ঘাটন সম্ভব হয়নি। এগুলো এমনভাবে সংরক্ষণ করা হতো যাতে সেগুলো পচেগলে নষ্ট না হয়ে যায়। যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকেই মিসরীয়রা ভূগর্ভস্থ কক্ষে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে মৃতদেহগুলোকে কবরস্থ করত।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে প্রাচীন মিসরীয়রা মমি তৈরির একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বের করে। কয়েকটি ধাপে এই মমি বানানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হতো। প্রথমে মৃতব্যক্তির নাকের মাঝে ছিদ্র করে মাথার ঘিলু ও মগজ বের করা হতো। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় লোহা জাতীয় জিনিস। তারপর মৃতদেহের পেটের বাম পাশে কেটে ভেতরের নাড়ি-ভুড়ি বের করে ফেলা হতো। এরপর শরীরের বিভিন্ন পচনশীল অঙ্গ যেমন- পাকস্থলী, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, যকৃত ইত্যাদি বের করে ফেলত। পরবর্তীতে কেটে নেয়া দেহের অংশগুলোকে চারটি বিশেষ পাত্রে রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে ডুবিয়ে রাখত। এরপর মৃতদেহ ও বের করা অঙ্গগুলোতে লবণ মাখিয়ে শুকানো হতো। যখন সব ভালভাবে শুকিয়ে যেত, তখন গামলা গাইন গাছের পদার্থ বা আঠা ও বিভিন্ন প্রকার মসলা মৃতদেহের গায়ে ঘষে-মেজে ভাল করে লেপে রেখে দেয়া হতো।