
ছবি: জনকণ্ঠ
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চম্পকনগর গ্রামে ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ। স্থানীয়ভাবে ‘ভাটির বাঘ’ নামে পরিচিত এই বীর পুরুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই সুড়ঙ্গটি আজও পর্যটকদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। সুড়ঙ্গের একটি মুখ রয়েছে বাংলাদেশে, অপর প্রান্ত ভারতে—যা এটিকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
এই সুড়ঙ্গ দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত পর্যটক। যদিও এর দৈর্ঘ্য বা বিস্তৃতি নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, তবুও স্থানীয় জনসাধারণের মতে এটি একটি প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ ছিল। কেউ কেউ আবার বলেন, শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বা গোপন চলাচলের জন্য এই সুড়ঙ্গটি ব্যবহৃত হতো। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, এটি শমসের গাজীর পরিবারের নারী সদস্যদের নিরাপদে গোসলের জন্য পুকুরে যাওয়ার গোপন পথ ছিল এই সুড়ঙ্গ।
শমসের গাজীর পরিচয়: ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র শমসের গাজীর জন্ম ফেনীর ছাগলনাইয়া অঞ্চলে। তার পিতার নাম পীর মুহাম্মদ (মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান) এবং মাতার নাম কৈয়্যারা বিবি। মূলত, তাদের আদি নিবাস ছিল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ওমরাবাদ পরগণার কচুয়া গ্রামে। দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের কারণে তার পরিবার ছাগলনাইয়ায় চলে আসে, যেখানে শমসের গাজীর পিতা জমিদার নাসির মন চৌধুরীর মুন্সি হিসেবে কাজ করতেন।
ছোটবেলায়ই শমসের গাজী পিতৃহারা হন। দারিদ্র্যের মাঝেও দুরন্ত স্বভাবের এই বালক তালুকদার জগন্নাথ সেনের আশ্রয়ে থেকে লেখাপড়া ও যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। যুবক বয়সে তিনি ডাকাত ও জলদস্যুদের দমন করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে জমিদার হন তিনি।
শমসের গাজীর ত্রিপুরা শাসন ও সংগ্রামের ইতিহাস:-
শমসের গাজী ছিলেন প্রজাবান্ধব শাসক। ফসলহানির কারণে কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে তিনি ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ত্রিপুরার মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের আদেশ অমান্য করে তিন বছর রাজকোষে খাজনা না দেওয়ায়, মহারাজ তার বিরুদ্ধে বাহিনী পাঠান। শমসের গাজী সেই বাহিনীকে পরাজিত করে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরসহ বিশাল অঞ্চল দখলে নেন। এক যুগের বেশি সময় তিনি ত্রিপুরা শাসন করেন, যার প্রধান কেন্দ্র ছিল চম্পকনগর।
শমসের গাজীর পতন ও রহস্যঘেরা মৃত্যু,১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার রাজনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। তখন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, স্থানীয় কুচক্রী মহল এবং পরাজিত মহারাজ একজোট হয়ে শমসের গাজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। ইংরেজদের আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী চম্পকনগরে হামলা চালিয়ে তাকে পরাজিত ও বন্দি করে। তবে তার মৃত্যুর বিষয়ে আজও নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি—যা তাকে ঘিরে রহস্য আরও ঘনীভূত করে।
শমসের গাজীর ঐতিহ্যের নিদর্শন গুলোর মধ্যে রয়েছে ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা—শমসের গাজীর ভিটা, দীঘি, বাঁশের কেল্লার ধ্বংসাবশেষ, এবং সর্বোপরি এই রহস্যময় সুড়ঙ্গ। যদিও তার প্রাসাদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বড় একটি অংশ বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতরে রয়ে গেছে, তবে বাংলাদেশের অংশটিও যথেষ্ট ঐতিহাসিক ও পর্যটন সম্ভাবনাময়। প্রতিদিন শতশত পর্যটকরা এই সুড়ঙ্গ ও শমশের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন গুলো দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে।
সাব্বির