সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে আমরা এখন দুটো আলাদা জগতে আলাদা সত্তা ধারণ করে বাস করছি। একটা আমাদের বাস্তবের দুনিয়া, আরেকটা হচ্ছে তথাকথিত ভার্চুয়াল দুনিয়া। বর্তমানে প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীই ভার্চুয়াল জগতে আরেকটি স্বতন্ত্র সত্তা ধারণ করেন। আর এই স্বতন্ত্র এতটাই যে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সঙ্গে তার বিন্দুবিসর্গ মিলও থাকে না। এই মাধ্যমগুলোর প্রতিটি প্রোফাইলই একেকটি আলাদা সত্তার বিমূর্ত রূপ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর এই পরিমাণ ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কী ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ এসব মাধ্যমে মানুষ এত বেশি সময় ব্যয় করছে, এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছে যে কখনও কখনও তার বাস্তব জ্ঞান আর থাকছে না। বাস্তবতা তার কাছে নিরর্থক হয়ে মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে করে মানুষের মনের ওপর স্বভাবতই চাপ পড়ছে, তার ভাবনা-চিন্তার পরিধি পাল্টে যাচ্ছে। বিশেষত ফেসবুক বর্তমানে তরুণ সমাজকে বেশি প্রভাবিত করছে। তরুণরা ফেসবুককে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে ধরে নিচ্ছে, তারা ফেসবুকের বিকল্প ভাবতে পারছে না। মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এভাবে নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার ফলে তরুণ সমাজ আজকে তাদের সমস্ত মানসিক উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। তারা হয়ে পড়েছে মানসিকভাবে অসুস্থ, অস্থিরচিত্ত, বিষণ্ণ। মানুষের সামগ্রিক মানসিক সুস্বাস্থ্যের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
অন্যের সঙ্গে তুলনা
ফেসবুকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। বিশেষত পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার একটি ভার্চুয়াল উপায় হিসেবে ফেসবুকের আবির্ভাব ঘটে (কিন্তু গন্ডগোলটা এখানেই, কারণ আমরা এখন এক ঘর থেকে অন্য ঘরেও ফেসবুক বা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করি)। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা এখন আমাদের বন্ধু বা চারপাশের মানুষজনের হাঁড়ির খবর জানতে পারছি। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখন যখন আমরা তার সঙ্গে নিজেদের হাঁড়ির তুলনা শুরু করি। আর যখনই আমাদের হিসেব মেলে না তখনই যত ঝুট-ঝামেলা উঁকি দেয়। অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা হয়, ‘সবার অঙ্ক মেলে, আমার অঙ্ক মেলে না।’ কারণ আপনি যখন অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন তখন সবসময় নিজের অবস্থাকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরেন। আপনার বন্ধুর ট্যুরে যাওয়ার ছবি দেখে আপনার মনে হয়, ট্যুরে কেন আমি যেতে পারছি না। তখন আপনি নিজের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা শুরু করেন। আর তখনই ঘটে যত বিপত্তি। দেখা গেল আপনি হয়তো টাকা জোগাড় করতে না পেরে বা পারিবারিক সমস্যার কারণে ট্যুরে যেতে পারেননি। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে মনটা হয়ে যায় বিষণ্ণ। হয়ত সেদিন পুরোটাই একরাশ বিষণ্ণতায় ডুবে থাকেন আপনি।
নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হওয়া
এই তো সেদিন বন্ধুদের আলোচনায় কথা হলো পরের সপ্তাহের ছুটিতে চাঁদপুর গিয়ে ইলিশ খেয়ে আসা যাবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ফেসবুকে দেখলেন বন্ধুরা আপনাকে না জানিয়েই বেড়াতে চলে গেছে। গেল আপনার মন খারাপ হয়ে। আচ্ছা, মন খারাপ হওয়াটা না হয় কিছুটা স্বাভাবিক, কিন্তু আপনি আরেকটু আগ বাড়িয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র, অপাঙ্ক্তেয়, অবাঞ্ছিত ভাবতে শুরু করলেন। হয়ত এই ঘটনায় বন্ধুতা সম্পর্কে আপনার বিচিত্র ধারণাও জন্মাতে পারে। আবারও সেই একই প্রশ্ন, ফেসবুক না থাকলে কি আপনার ভাবনার জগতে এত ঝড় বইত?
আবার ধরুন, আপনি আপনার কোন বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলেন। বেশ আনন্দ, ফুর্তি, খাওয়া-দাওয়ার পর বাসায় এসে ঘুমানোর আগে ফেসবুক খুলে বসে দেখলেন আপনার বার্থ ডে বয় বন্ধুটি ফেসবুকে যেসব ছবি আপলোড করেছে সেগুলোর একটাতেও আপনি নেই, থাকলেও একেবারে পেছনে। এ রকম দেখে আপনি নিশ্চয় আপনাকে ওই অনুষ্ঠানে অনাহূত ভাববেন। ফেসবুকটা না থাকলে এই ট্র্যাজেডিটা একদমই হতো না।
সময় হয়ে যায় আপেক্ষিক
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কৌতুক করে বলেছিলেন, আপনার হাত গরম উনুনের ওপর এক মিনিট রাখুন, দেখবেন এক ঘণ্টা মনে হবে। সুন্দরী একটা মেয়ের পাশে এক ঘণ্টা ধরে বসে থাকুন, মনে হবে মাত্র এক মিনিট বসেছেন।
ফেসবুকে বসলে আমাদের আর সময় জ্ঞান থাকে না, এ এক অমোঘ সত্য। আমরা অল্প কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুকে থাকব মনে করলেও নিজেদের অজান্তেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ফেসবুকে ব্যয় করি। কখনও নিউজফিডে অলস স্ক্রলিং আবার কখনও অপরিচিত ব্যক্তির প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা (Stalking)- এসব কাজেই আমাদের মূল্যবান সময় অপচয় হয়। এ ছাড়া রয়েছে চ্যাটিংয়ের ব্যবস্থা। অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হতে বাস্তবে অনেকেই অপছন্দ করলেও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তাতে মোটামুটি সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে কারণ এখানে দায়বদ্ধতার বালাই নেই। সোজা কথায়, ফেসবুক আমাদের সময় ‘খেয়ে নেয়।
প্রাক্তন ও ফেসবুক কথন
আজকালকার দুনিয়ায় প্রেম করার সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হচ্ছে ফেসবুক। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রেমের সূচনাও হয় ফেসবুকে। ফেসবুকে ছবি দেখে প্রেম, তারপর বাস্তবের রূপ দেখে থ বনে যাওয়া- এ নিয়ে তো কত গল্প, কৌতুক প্রচলিত আছে। কিন্তু আসল কথা হলো, ফেসবুক প্রেমের আমেজ দিতে যতটুকু না সাহায্য করছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে ব্রেকআপের পর। অধিকাংশ ব্যর্থ প্রেমিক/প্রেমিকাই প্রেম ভেঙ্গে যাওয়ার পরে প্রাক্তনের প্রোফাইল নিয়মিত ঘুরে বেড়ান। এতে যে দুঃখ বাড়ে তা হয়তো শতভাগ জোর দিয়ে বলা যায় না, কিন্তু সুখের মাত্রাটা যে ইতিবাচক রেখার দিকে বৃদ্ধি পায় না তা হলফ করে বলা যায়। ফলাফল আবারও বিষণ্ণতায় ডুবে যাওয়া। প্রাক্তন যদি নতুন প্রেমে পড়ে আর তার অভিসারের কর্মকা- ফেসবুকে প্রকাশ করে তাহলে তো একেবারে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। না পাওয়ার বেদনা করুণ কিন্তু যদি দেখা যায় সেই ঈপ্সিত বস্তু অন্য কেউ খুব সহজে অধিকার করে নিয়েছে তাহলে সেই কষ্ট অপার্থিব।
লাইক ও কমেন্টের সংগ্রাম
মনে পড়ে প্রথম যেবার ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খুলে প্রোফাইলে ছবি টাঙিয়ে ছিলেন, সেবার কত ‘লাইক’ পেয়েছিলেন? আচ্ছা, যা-ই পান না কেন, তখন কি কোন আক্ষেপ হয়েছিল লাইক-কমেন্টের সংখ্যা নিয়ে? আর এখন কি হয়? বেশিরভাগ মানুষই এই প্রশ্নের উত্তরে না-বোধক জবাব দিলেও মনে মনে কিন্তু সবাই এর উল্টোটাই লালন করেন। সবারই মনে একটা সুপ্ত বাসনা থাকে বেশি বেশি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ারের জন্য। এই বাসনা অমূলক নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু যখন আপনি লাইক-কমেন্টের সংখ্যা নিয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে যান, তখনই সমস্যা শুরু হয়ে যায়। এসবের সংখ্যা বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখানুভূতির মাত্রাটাও বাড়তে থাকে। আবার লাইক-কমেন্ট না জুটলে মন খারাপ হয়, নিজেকে ব্যর্থও মনে হতে থাকে। আমাদের ফেসবুক ব্যবহারের একটা বড় অংশইজুড়ে রয়েছে এই লাইক-কমেন্টের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আক্ষেপ।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯-৩২ বছর বয়সীরা যত বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের বিষণ্ণতায় ভোগার হারও তত বেশি। তারা ‘বিষণ্ণতার অসীমচক্রে বন্দী।’ সাইবারবুলিয়িং, নেতিবাচক তুলনা ইত্যাদির কারণে বিষণ্ণতা ও চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে। ফেসবুকে অতিরিক্ত আসক্তির কারণে স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কিত জটিলতা, মনস্তাত্বিক উত্তেজনা এমনকি সামাজিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত আসক্তির কারণে মানুষ ফেসবুকে এত বেশি সময় ব্যয় করে যে ঘুমানোর প্রয়োজনীয় সময়টুকুও পায় না। ঘুম কম হলে নানা রকম শারীরিক অসুবিধা তো হয়ই, পাশাপাশি অপরিমিত ঘুম আচরণগত পরিবর্তনও ডেকে আনতে পারে।
ফেসবুক যোগাযোগের একটি মাধ্যম হলেও যোগাযোগের সবটুকু আনন্দ এতে পাওয়া যায় না। কারণ বাস্তব যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা যেসব অবাচনিক যোগাযোগ রূপগুলো (Nonverbal gestures) দেখি ও অনুধাবন করি, ফেসবুকে তা করার কোন উপায় নেই। এমনকি যোগাযোগের ক্ষেত্রে শারীরিক নড়াচড়ার (Bodily movement) যে ভূমিকা, তা-ও ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত। সুতরাং ফেসবুক যোগাযোগের যন্ত্র হলেও তা বাস্তব যোগাযোগ ব্যবস্থার সবগুলো প্রয়োজনীয় উপাদানকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।
তবে সব কথার শেষ কথা হলো, ফেসবুক আপনাকে কতটা মানসিক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে তা নির্ভর করছে আপনি কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন তার ওপর। ব্যবহারকারীই ঠিক করবেন ফেসবুককে তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন নাকি ফেসবুক তার ওপর নিয়ন্ত্রণ ফলিয়ে তার মানসিক অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তুলবে।