ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আব্দুল আলীম

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৬ এপ্রিল ২০১৮

 শিশুর শারীরিক ও  মানসিক বিকাশ

সাড়ে চার বছর বয়সের নীলা। এই বয়সের অন্যসব শিশু থেকে তার আচরণ একটু ব্যতিক্রমী, ঠিক পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়। সে পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে দেখলে ভয় পায়। কখনও দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। আদর করে তাকে কোলে নিতে গেলেও, চিৎকার করে কাঁদে। বাড়িতেও সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এ বয়সী শিশুদের অন্য মানুষ দেখে ভয় পাওয়ার কথা নয়। এ বয়সে নানা রকম প্রশ্নবানে বড়দের ব্যতিব্যস্ত করে রাখার কথা, বিভিন্ন জিনিসের আবদার করার কথা। কিন্তু শিশু নীলার ক্ষেত্রে এই স্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় না। খাবার গ্রহণে তার তেমন কোন আগ্রহ নেই। অল্পতেই রেগে যাওয়া, আবার কখনও কখনও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে। নীলার এ আচরণে বাবা-মা খুবই চিন্তিত আর বিরক্ত। তারই বয়সী পাশের বাড়ির রায়হান কত হাসি-খুশি, চটপটে। সাবাই তাকে খুব আদর করে। সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত, দেশ গড়ার কারিগর। কিন্তু তাদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশসহ মেধা এবং মননের জন্য সহায়ক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে পিতা-মাতা, পরিবার ও সমাজের কি করণীয়, সে বিষয়ে অনেকেরই সচেতনতার অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে অসচেতনতা, অশিক্ষা বা অজ্ঞতাই মূল কারণ তা নয়, এর সঙ্গে যুক্ত পারিবারিক উদাসীনতা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি। শিশুর বেড়ে ওঠার বিষয়টিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়Ñ জন্মপূর্বে মাতৃগর্ভে ভ্রুণ আকারে বেড়ে ওঠা এবং ভূমিষ্ঠের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠা। অনেকেই মাতৃগর্ভে শিশুর বেড়ে ওঠাকে খুব গৌণ ও কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেন। কিন্তু এ কথা সবারই জানা প্রয়োজন, একটা ভাল বীজ যেমন নিশ্চিত করে একটি সুস্থ সবল বৃক্ষ, তেমনি একজন সুস্থ মাই নিশ্চয়তা দেয় সুস্থ সন্তানের। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ সুন্দর শিশুর নিশ্চয়তা তাই মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই গর্ভবস্থায় মাকে সঠিক পরিচর্যা এবং পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে আগত শিশুর জন্য। জন্মের পর শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। জন্মের পর পরই নবজাতককে মায়ের বুকের প্রথম দুধ যা শাল দুধ বলে পরিচিত, তা দিতে হবে। শিশুর জন্য শাল দুধ খুবই পুষ্টিকর, নিরাপদ ও রোগ প্রতিরোধক। তাছাড়া এতে শিশুর জন্য অত্যাবশ্যকীয় সব পুষ্টি উপাদান যথা- প্রোটিন, শর্করা, ভিটামিন, স্নেহ, খনিজ লবণ ও পানি সঠিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে, যা শিশুদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শিশু জন্মের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধই একমাত্র খাবার। এ সময় অন্য কোন খাবারের প্রয়োজন হয় না। ছয় মাস বয়সের পর থেকে দু’বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবারও খাওয়াতে হবে শিশুকে। পুষ্টিকর খাবার ও সঠিক যত্ন যেমন শিশুর বিকাশকে ত্বরান্বিত করে, তেমনি শিশুর দৈহিক গঠন ও মেধা মননের বিকাশের জন্য খেলাধুলার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা আনন্দময় অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। শিশুর খেলাধুলায় মা-বাবার অংশগ্রহণ সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে যা শিশুর বুদ্ধি বিকাশের ধারাকে আরও সহজ করে দেয়। তাছাড়া শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য শিক্ষার পরিবেশ এমন হওয়া উচিত, যেখানে অবাধে সে তার মতামত, চিন্তা ও ধারণা প্রকাশ করতে পারে। মা-বাবা ও শিক্ষকদের উচিত শিশুকে ধাপে ধাপে শেখার সুযোগ করে দেয়া। যাতে শিশুরা সহজে তা গ্রহণ করতে পারে। এ জন্য ধৈর্য, সহমর্মিতা, দক্ষতা, খেলাধুলা এবং আনন্দের মাধ্যমে শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে। এতে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ সুন্দর, সুষ্ঠু ও আনন্দপূর্ণ হবে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সঙ্গে বড়দের আচরণ হওয়া উচিত বন্ধুর মতো। মনে রাখতে হবেÑ শিশুরা যে রকম ব্যবহার পায়, অন্যদের সঙ্গে তারা সে রকম ব্যবহার করে। শিশুরা পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। শিশু বয়সে আবেগ একটু বেশি থেকে। তাই বাবা মাকে অত্যন্ত ধৈর্য, সতর্কতা এবং সহানুভূতির সঙ্গে শিশুর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যায়ন করা উচিত। শিশুর প্রতি অমনোযোগী হলে শিশুর মনে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং সে তার জীবনের প্রতি আকর্ষণ ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। তাই মা-বাবাসহ পরিবারের সকলেরই অকুণ্ঠ ভালবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে সহায়তা করা উচিত। আজকের দায়িত্ব বড়দের আর আগামী দিনের দায়িত্ব অবশ্যই শিশুদের। তাই নিলার মতো শিশুদের আচরণগত সমস্যাগুলো আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বুঝতে হবে, শিশু কেন এই অস্বাভাবিকতা দেখাচ্ছে। কেন তার মানসিক পরিপূর্ণতা হয়নি? তা না হলে বহু শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পরিপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে আমাদের ব্যর্থতা থেকে যাবে। আর এ ব্যর্থতা আমাদের জাতীয় জীবনে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলার জন্য সর্বোত্তভাবে আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে বিশেষ করে বাবা-মায়ের এ দায়িত্ব অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবেই কেবল আমরা আমাদের শিশুর যথাযথ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ কাক্সিক্ষত পরিবেশে গড়ে তুলতে পারব।
×