
এই সপ্তাহটা ইসরায়েলের জন্য মোটেও সুখকর নয়।তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিক থেকেও বিষয়টি তেমন উদ্বেগজনক মনে হচ্ছে না। বাস্তবত, তিনি যেন ইচ্ছা করেই নানা কৌশলে এই বার্তাটি দিচ্ছেন: নিজের স্বার্থেই তিনি সবকিছু করবেন, এমনকি তাতে যদি দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েলকেও বাদ দেওয়া লাগে, তাহলেও পিছপা হবেন না।
ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন এক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে, যেখানে ইসরায়েল ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে। গাজা থেকে হামাসের সর্বশেষ জীবিত একজন মার্কিন পাসপোর্টধারী বন্দি মুক্তি পাওয়ার সময়টা যেমন,ঠিক তখনই ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফরে বেরিয়ে পড়েন, যেখানে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থাকলেও ইসরায়েল নেই। অথচ মার্চে একই ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে দিয়েছিল, ইসরায়েল যেন আলোচনার বাইরে না পড়ে যায় সেই ভাবনায়। এবার আর সেই চিন্তা করেনি ট্রাম্প প্রশাসন।
ইয়েমেনেও একই রকম চিত্র। হুথিদের ওপর বোমাবর্ষণ বন্ধের ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প বলেন, “আমরা তাদের ভালোভাবে মেরেছি। ওরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর আমরা সেটা সম্মান করি।” কিন্তু তিনি উল্লেখ করেননি যে, এই হুথিরাই কিছুদিন আগেই তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে আর এই সিদ্ধান্তে ইসরায়েলকে কিছুই জানানো হয়নি।
ইরান নিয়েও দুই দেশের মধ্যে স্পষ্ট মতবিরোধ। নেতানিয়াহু চান, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে তাকে সহায়তা করুক। কিন্তু ট্রাম্পের লক্ষ্য যুদ্ধ নয়, বরং ‘শান্তির পুরস্কার’।সোজা কথা, নোবেল প্রাইজ। “আমি ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চাই,”মঙ্গলবার এমনটিই বলেন ট্রাম্প, যা নেতানিয়াহুর জন্য ছিল অপমানজনক। “আমি যদি চুক্তি করতে পারি, তবে আমি খুব খুশি হব।”
সিরিয়াকেও ঘিরে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। যেখানে ইসরায়েল এখনো সেখানে বোমা ফেলছে, সেখানে ট্রাম্প সিরিয়ার নতুন নেতা আহমেদ আল-শারা’র সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা করছেন এবং দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথাও ভাবছেন।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের মূল লক্ষ্যগুলোতেও ইসরায়েলের কোনো স্থান নেই। যদিও ট্রাম্প গর্ব করেন ‘আব্রাহাম চুক্তি’ নিয়ে, যেখানে কয়েকটি মুসলিম দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, কিন্তু এবার তিনি সৌদি আরবের কাছ থেকে তেমন কোনো কূটনৈতিক অর্জনের চেষ্টা করছেন না। বরং সৌদি, কাতার ও আমিরাতের রাজপরিবারগুলো ট্রাম্পকে খুশি রাখতে ব্যস্ত।নতুন ট্রাম্প টাওয়ার বানানো, গলফ টুর্নামেন্ট আয়োজন, তার পরিবারের সঙ্গে ব্যবসা, এমনকি একটি বিলাসবহুল বোয়িং ৭৪৭-৮ উপহার দেওয়ার প্রস্তাব পর্যন্ত এসেছে।
এই দেশগুলো বুঝে ফেলেছে ট্রাম্পকে তুষ্ট করা মানেই বিনিময়ে তারা অনেক কিছু পাবে, এমনকি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি না দিয়েও হয়তো পার পেয়ে যাবে। কারণ, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও জানেন নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থি সরকার ফিলিস্তিনে যা করছে, তাতে ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেওয়া এখন অসম্ভব।
গাজায় স্থায়ী দখল, ভবনসমূহ গুঁড়িয়ে দেওয়া, ২০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা এখন খোলামেলা ভাবেই সামনে এসেছে। জাতিসংঘ পর্যন্ত বলছে প্রায় পাঁচজন গাজাবাসীর মধ্যে একজন এখন অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে।
ট্রাম্প এসব নিয়ে মুখ খুলছেন না। হয়তো তিনি জানেন, নেতানিয়াহুকে থামানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার হয়তো এমন বিপর্যয়ের সঙ্গে নিজের নাম জড়াতে চান না। যদি তাই হয়, তবে এটি আরেকটি প্রমাণ ট্রাম্প প্রকৃত অর্থে ইসরায়েলের বন্ধু নন।
জো বাইডেন বরাবরই ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছেন, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি বিশ্বাস করেন ফিলিস্তিনের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পাশেই টিকে থাকতে পারে ইসরায়েল। সে কারণেই তিনি নেতানিয়াহুকে বারবার দিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন, যদিও তা ব্যর্থ হয়েছে। রিপাবলিকানরা এই কারণেই বাইডেনকে ‘অপর্যাপ্ত ইসরায়েল-সমর্থক’ বলে আক্রমণ করেছে।
ট্রাম্প বিপরীত পথে হেঁটেছেন। প্রথম মেয়াদে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মতো নাটকীয় পদক্ষেপ নিয়ে নিজেকে ‘জায়োনিস্ট’ হিসেবে দাবি করলেও তিনি কখনোই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাস্তব পদক্ষেপ নেননি। বরং সম্প্রতি তিনি এমন বিস্ময়কর ঘোষণা দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করে সেটিকে “মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা” বানাবে! যদিও এখন নেতানিয়াহুই গাজা দখলের পরিকল্পনা করছেন, ট্রাম্প সেই প্রস্তাব চুপিচুপি গিলে ফেলেছেন।
এই দ্বন্দ্ব আসলে দুই স্তরে: একদিকে ব্যক্তিগত, অন্যদিকে ঐতিহাসিক। ব্যক্তি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু দুজনই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক এবং নিজের স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে তুলে ধরতে অভ্যস্ত। ফলে তাদের সম্পর্ক স্থায়ী হওয়াটা প্রায় অসম্ভব।
আর ঐতিহাসিকভাবে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন এক সিদ্ধান্তের পথে হাঁটছে, যেখানে দীর্ঘদিনের বন্ধু ইসরায়েল ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে বিশ্ব রাজনীতিতে।
সূত্র:https://tinyurl.com/5cuzk978
আফরোজা