ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর

কম্পিউটার অপারেটর পদে ঢুকছেন ইঞ্জিনিয়াররা

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ১৩:০১, ১২ নভেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৩:৪৩, ১২ নভেম্বর ২০২২

কম্পিউটার অপারেটর পদে ঢুকছেন ইঞ্জিনিয়াররা

শিক্ষা ভবন

কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা বলছেন শিক্ষাবিদরা

কর্মমুখী শিক্ষা বাড়ানোর তাগিদ


শুধু বিসিএস নয়। চাকরির বাজারের নিচের গ্রেডের পদগুলোতেও ভিড় জমাচ্ছে মাস্টার্স ডিগ্রীধারীরা। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর পদগুলোতে যোগ্যতা যেখানে এইচএসসি পাস। সেখানেও আবেদন করছেন স্নাতক পাস আবেদনকারী। অবাক করার মত তথ্য হল কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগদান করছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। 

সম্প্রতি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষায় জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে এ চিত্র উঠে এসেছে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীর পদে যেসব প্রার্থী চাকরি পেয়েছেন তার ৮০ ভাগ দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাাতকোত্তর ডিগ্রীধারী।

জনকন্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৩ গ্রেডের কম্পিউটার পদে যারা যোগদান করেছেন তাদের প্রায় ২০ ভাগ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। আসনাদ আহমেদ সজল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) পাস করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগদান করেন। মো. ফয়সাল হোসেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিএসই পাস করে যোগ দিয়েছেন এই চাকরিতে। 

মো. গোলাম রাব্বী, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মৃণাল দেবনাথ, লাকী সুলতানা লাভলী, আল আমিন হোসেন বিল্পব কম্পিউটার অপারেটর পদের চাকরিতে যোগদান করেছেন। অথচ এরা সবাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়াও এই পদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেকচার, কুয়েট থেকে লেদার টেকনোলজী, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান থেকে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর করা শিক্ষার্থী আছেন।

শিক্ষা প্রকৌশলের নিয়োগ বোর্ডের কর্মকর্তারা জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর নয়, সরকারি  সব চাকরির পরীক্ষায় একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। চাকরির বাজার খারাপ ও উচ্চশিক্ষার বেহাল দশা অন্যতম কারণ হতে পারে। এসএসসি ও এইচএসসির নূন্যতম যোগ্যতা চাওয়া হলেও আবেদন করছেন ৮০ ভাগ আবেদনকারী অনার্স ও মাস্টার্স পাস। এর আগে ক্যাডার বা নন ক্যাডার পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় দেখা যেত। এখন ১৬ গ্রেডের চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় তাদেরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ১২ পদে ১১৯৪ জনকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। এরমধ্যে হিসাবরক্ষক পদে ২৫, কম্পিউটার অপারেটর পদে ৬৯, সাটলিপিকারে ২, উচ্চমান সহকারী ৩১, সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম-কম্পিউটার অপারেটর ১, স্টোর কিপার ১, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ৪০, অফিস সহকারী কাম ক্যাশিয়ার ২১, হিসাব সহকারী কাম ক্যাশিয়ার ১৪, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে ৪৬৪, অফিস সহায়ক ৫১৫, নিরাপত্তা প্রহরী পদে ১১ জন। অফিস সহায়ক ও নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়া সব পদের ফল প্রকাশ ও যোগদান শেষ পর্যায়ে আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একাউন্টটেন্ট ১৩ তম গ্রেডের পদ। এই পদে যারা চাকরি পেয়েছেন তারা প্রায় সবাই মাস্টার্স পাস। এদের অর্ধেকই দেশের সেরা সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। যারমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীররগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রয়েছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ, অতীশ দিপঙ্কর, এআইইউবি, আইইউবিএটিসহ একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ পদে চাকরি বাগিয়েছেন।

ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদটি ১৬ গ্রেডের। এই পদে আবেদনের যোগ্যতা ছিল এইচএসসি পাস। তবে  ৯৫ ভাগ স্নাতক পাস আবেদনকারী এখানে আবেদন করেন। ফল হিসেবে চাকরিও পেয়েছেন উচ্চশিক্ষিতরা। এই পদে যোগদান করেছেন মো. আজহারুল ইসলাম যিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতোকত্তর শেষে যোগদান করেছেন সাইফুল ইসলাম। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশরাফ হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসুম উদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আতাউর করিম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স পাস করে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে যোগ দিয়েছেন। আইনুল হক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, এস কে আরিফ এমবিএ পাস করেছেন। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স  শেষে আহসান হাবীবও একই পদে যোগদান করেছেন।
 
হিসাব সহকারী পদটি ১৬ গ্রেডের। এই পদে ৪৩ জন উত্তীর্ণ হলেও যোগদান করেছেন ৩২ জন। যাদের সবাই মাস্টার্স পাস। এই পদে যারা যোগদান করেছেন তাদের অধিকাংশই গণিত, ফিন্যান্স, মার্কেটিং ও এমবিএ পাস বলে জানা যায়। ১৬ গ্রেডের অফিস সহকারী কাম ক্যাশিয়ার এই পদে ২২ জনের মধ্যে ১৯ জন যোগদান করেছেন। এই চাকরির আবেদনে এইচএসসি পাস চাইলেও চাকরি পেয়েছেন মাস্টার্স পাসের শিক্ষার্থীরা। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদ বিশ্বাস ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করে এই পদে যোগদান করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুকদেব বিশ্বাস (দর্শন), সঞ্জয় কুমার শীল (গণিত)। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারজানা আক্তার সুমী গণিত বিষয়ে  স্নাতোকত্তর শেষ করে নিচের গ্রেডের এ পদে চাকরি নিয়েছেন।

নিয়োগ পরীক্ষার বোর্ডের সদস্যরা জানান, এসএসসি পাস রিকোয়েরমেন্ট থাকলেও এসব চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে মাস্টার্স পাস শিক্ষার্থী। ফলে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় টিকতে পারছে না। যেকারণে ভাইভা পরীক্ষায় শতভাগ মাস্টার্স পাস করা পরীক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে। এর জন্য দুই ধরণের সমস্যা হচ্ছে। 
একটি হল যাদের চাকরি হচ্ছে তাদের অনেকেই পরবর্তীতে এর চেয়ে ভাল গ্রেডের পোস্ট নিয়ে অন্য চাকরিতে চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পদটি দীর্ঘ দিন খালি থাকছে। এই পদে যে এইচএসসি পাসের একজনের চাকরি করার কথা ছিল তিনি কিন্তু কার্যত বেকার থাকছেন।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরিচালক প্রশাসন (উপসচিব) রাহেদ হোসেন জনকন্ঠকে বলেন, দেশের বেসরকারি পর্যায়ের কলেজগুলোতেও অনার্স খোলা হয়েছে। এরফলে  অনেকেই খুব সহজেই নূন্যতম উচ্চশিক্ষা অর্জন না করেও সনদ লুফে নিচ্ছেন। যেকারণে সার্টিফিকেটের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিনি আরোও বলেন, ১৬-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিতে অধিকাংশই মাস্টার্স পাস ডিগ্রীধারী মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের মধ্য প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীও ছিল।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন যখন শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা বেকার হয়ে বসে আছেন। তখন কম যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিগুলোতেও তারা আগ্রহী হয়ে উঠে। সেকারণে কম্পিউটারের উপর বেসিক নলেজ থাকলেই যেখানে চলে সেখানে কম্পিউটার প্রকৌশলীরা যোগদান করছেন। বলা যায় আমাদের দেশে চাকরির বাজারে বড় ধরণের সংকট চলছে। কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা আছে। 

সেই কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। উচ্চশিক্ষিত ছেলে মেয়েরা যখন কম বেতন ভাতার চাকরিতে যোগদান করে তখন তারা হতাশ হয়ে পড়ে। প্রত্যেকেই যেন যোগ্যতা অনুসারে চাকরি-বাকরি পায় সে বিষয়টা আরও জোরালো করা দরকার। তিনি বলেন, শিক্ষা পরিকল্পনা এমন করা উচিত যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্প্রসারণ করলেই হবে না। পেশাগত দক্ষতা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মিড লেভেলে এগুলো বাড়াতে হবে। যেকারণে চাকরির বাজারে এক ধরণের অসমতা আমারা লক্ষ্য করছি। এর থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

দেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮ লাখ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালইে ৪০ লাখের বেশি অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী আছেন। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যার জন সংখ্যাও এর সমান নয়। শিক্ষার্থীদের শুধু উচ্চশিক্ষিত ও সরকারী চাকরির পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করা দরকার। 

দেশের এখনো অনেক কাজের সেক্টর আছে যেখানে চাকরীদাতারা চাকরিপ্রার্থী খুঁজে পান না বলে মনে করেন ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে যুগউপযোগী বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার। এজন্য শুধু চাকরির পেছরে ছুটলেই হবে না। প্রয়োজন নিজেকে স্বনির্ভর ও উদ্যোক্তা তৈরি করা। 

আমাদের উচ্চশিক্ষার যে সিলেবাস তা সময়উপযোগী কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সিলেবাসে কোন সমস্যা নেই। আমাদের এখনো কিছু অপ্রচলিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। যা কর্মক্ষেত্রে কোন কাজে আসছে না। একারণে কর্মমূখী শিক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, উচ্চশিক্ষা বন্ধ নয় বহাল রাখতে হবে। তবে উচ্চশিক্ষা সবার জন্য না। এইচএসসি পাস করার পরে কারিগরি, বৃত্তিমূলক যেসব ডিসিপ্লিন দরকার ছিল নানা রকমের পরিকল্পনা স্বত্তেও তা গড়ে উঠেনি। 

আমাদের মন মানসিকতাই হল অনার্স বা মাস্টার্স পাস করতে হবে। এরজন্য সামাজিক পরিবর্তনের দরকার। আমাদের মানসিকতায় একটি দপ্তরে বা চেয়ারে বসে কাজ করার প্রবণতা আছে।  যেকারণে স্ট্রাকচারে কিছু জিনিসের পরির্তন সময়ের দাবী বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এসআর

×