
যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়ার পর ইরানিদের উল্লাস। ইনসেটে বাঁ থেকে- আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
অবশেষে ইরান-ইসরাইল ১২ দিনের লড়াইয়ের অবসান। মঙ্গলবার ভোর থেকে উভয় দেশের মধ্যে কাক্সিক্ষত যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। খবরটি দিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর। দয়া করে এটি কেউ লঙ্ঘন করবেন না। তিনি আরও বলেন, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে, যদি উভয় পক্ষই তা মেনে চলে। এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, উভয় দেশের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি ১২ ঘণ্টা ধরে চলবে। এরপরই যুদ্ধকে সমাপ্ত হিসেবে ঘোষণা করা হবে। যুদ্ধবিরতির খবরের মধ্যেও মঙ্গলবার ইরানে হামলা চালায় ইসরাইল।
এতে দেশটির একজন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন। এ খবরে বেজায় চটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে ইরানে ফের হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এরপর তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমার সঙ্গে ¯্র্েরফ ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন। মঙ্গলবার ইউরোপ সফরে বের হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করে ট্রাম্প আরও বলেন, নেতানিয়াহুর এই ধরনের আচরণে আমি বেজায় ক্ষুব্ধ। তিনি আমার কথা রাখলেন না। ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শর্ত লঙ্ঘন। বিষয়টি হতাশাজনক। আমি ইসরাইলের কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি। খবর আলজাজিরা, পার্স টুডে, বিবিসি ও মেহের নিউজ অনলাইনের।
যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সম্মতি নিশ্চিত করতে সোমবার ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এরপর ইরানকে রাজি করাতে কাতারের কূটনৈতিক সহায়তা নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও ইসরাইল হামলা চালায়। এর জবাবে ইরানও সোমবার বিকেলে কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এই হামলা পাল্টা হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি ট্রুথ সোশ্যালে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লেখেন, ইসরাইল, বোমা ফেলা একদম বন্ধ করুন। যদি আপনারা এটা বন্ধ না করেন, তাহলে তা হবে যুদ্ধবিরতির গুরুতর লঙ্ঘন। এখনই, এই মুহূর্তে নিজেদের পাইলটদের ফিরিয়ে আনুন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই মনোভাব ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর এই আচরণে ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশল বিঘিœত হয়েছে। কারণ তিনি যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করে নিজের কূটনৈতিক দক্ষতার একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইসরাইলের আচরণ সেই উদ্যোগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এই অবস্থাকে রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা দেখছেন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কৌশলের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে। সেই সঙ্গে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিম-লে ট্রাম্পের এই ক্ষোভ এবং নেতানিয়াহুর ওপর বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পরিস্থিতি কূটনৈতিক সম্পর্ককে কতটা প্রভাবিত করবে, তা সময়ই বলে দেবে।
একই দিন ইরানে সরকার পরিবর্তন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ইরানে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার উৎখাতে আমি আগ্রহী নই। কারণ তা আরও অস্থিরতা ডেকে আনবে। তবে গত রবিবার ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লিখেছিলেন, ‘সরকার উৎখাত’ শব্দটি রাজনৈতিকভাবে ঠিক নয়। তবুও যদি বর্তমান ইরান সরকার ‘ইরানকে আবার মহান করে তুলতে না পারে’, তবে সরকার উৎখাত কেন নয়।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইরানজুড়ে পালিত হচ্ছে বিজয় উৎসব। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরপরই ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক মহলে দেখা গেছে উচ্ছ্বাস। মঙ্গলবার তেহরানসহ দেশের বিভিন্ন শহরে রাস্তায় নেমে আনন্দ মিছিল করে হাজার হাজার মানুষ। স্লোগানে মুখরিত হয়েছে রাজধানী, আগুন জ্বালিয়ে উদযাপন করা হয়েছে ‘জয়’।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পরই ইরানের শীর্ষ নেতারা একে ‘ঐতিহাসিক জয়’ হিসেবে আখ্যা দেন। ইরানের বিভিন্ন শহরে বিজয় র্যালি ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা আরেফ বলেন, এই বিজয়ের মাধ্যমে ইরান শুধু সামরিক নয়, কূটনৈতিক অঙ্গনেও প্রমাণ করেছে-আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির শিং ভেঙে দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের আছে। এটাই ইরানের প্রকৃত শক্তির বহির্প্রকাশ। ইরানের সংসদের স্পিকার ও প্রাক্তন আইআরজিসি কমান্ডার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফের উপদেষ্টা মাহদি মোহাম্মাদি একে একটি যুগান্তকারী বিজয় বলে মন্তব্য করেন। এক্সে দেওয়া বার্তায় তিনি লিখেছেন, একটি নতুন যুগের সূচনা হলো।
পারমাণবিক ইস্যুতে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে, পারমাণবিক শক্তি অধিদপ্তরের মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি জাতীয় টেলিভিশনে বলেন, আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেউ উপড়ে ফেলতে পারবে না। আমাদের সক্ষমতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির কারণে এই খাত আর কখনো থেমে থাকবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি ইরানের জন্য কৌশলগতভাবে একটি সফলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এতে সরাসরি সংঘাত থেকে সরে এসে ইরান একটি ‘শক্ত অবস্থান’ নিয়ে আলোচনায় বসার সুযোগ পেয়েছে। পাশাপাশি নিজ দেশের জনগণের কাছে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা তুলে ধরার সুযোগও তৈরি হয়েছে।
ইরানের শহরগুলোতে বিজয় উদযাপনে মুখর জনগণ। রাস্তায় নেমে তারা ‘আমেরিকা নিপাত যাক’, ‘ইসরাইল ধ্বংস হোক’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখর হয়। বহু জায়গায় দেখা গেছে পতাকা মিছিল, ধর্মীয় সংগীত ও বিপ্লবী স্লোগান।
তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতিক মহলে যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-ইসরাইল বৈরিতা বহু দশকের, ফলে এই যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী হবে, তা নিশ্চিত নয়।
চলতি বছরের ১৩ জুন ইসরাইল ইরানের ভুখ-ে হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইলে। এতে উভয় দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘাত চরমে পৌঁছালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে সমন্বয় করে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। শেষ পর্যন্ত, এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, যা উভয় দেশ মেনে নিতে সম্মত হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে আপাতত এই সংঘাতের অবসান ঘটে।
ইরান বলছে, এই যুদ্ধবিরতি শুধুই সাময়িক বিরতি নয়, বরং এটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে- তারা ভয় পায় না, বরং প্রতিরোধ করতে জানে। তেহরান মনে করছে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তারা এখন আরও দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে।
মাঝআকাশে আটকা পড়েন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ॥ লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নওয়াফ সালাম সোমবার কাতার সফরে যাচ্ছিলেন। তাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ছিল মাঝআকাশে। হঠাৎ কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে নিজেদের আকাশসীমা সাময়িক বন্ধ করে দেয় কাতার। এ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েন লেবাননের প্রধানমন্ত্রীও। কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান।
এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। শুধু কাতার নয়, আশপাশের কুয়েত ও বাহরাইন নিজেদের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এ সময় লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর অনিশ্চয়তায় পড়ার বিষয়টি জানান দেশটির সরকারের একজন উপদেষ্টা।
কাতারকে ইরানের ধন্যবাদ ॥ প্রতিবেশী কাতারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ইরান। আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করায় মঙ্গলবার দেশটি এ ধন্যবাদ জানায়। ইরানের ইয়ং জার্নালিস্ট ক্লাব জানিয়েছে, ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাখত-রাভানচি কাতারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। দেশটি এই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করায় তিনি এ কৃতজ্ঞতা জানান।
কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ আল-খুলাইফির সঙ্গে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাখতেরাভানচি টেলিফোন আলাপ করেন। এ সময় তিনি তাকে গঠনমূলক ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান। আলোচনায় তাখতেরাভানচি বলেন, ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশিত্ব ও সর্বোচ্চ পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে ইরান দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার ও স্থায়ী করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
মুখ খুলল চীন ॥ ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ যুদ্ধবিরতি নিয়ে মঙ্গলবার মন্তব্য করেছে চীন। প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চীন। দেশটি জোর দিয়ে বলেছে, যুদ্ধ নয়, আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান সম্ভব। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন মঙ্গলবার বেজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার ঘূর্ণাবর্ত দেখতে চাই না। আশা করি, যুদ্ধবিরতি দ্রুত কার্যকর হবে।
ইরান ও ইসরাইলের যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার পর চীন এ মন্তব্য করেছে। গুও জিয়াকুন আরও বলেন, চীন ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। দেশটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে রাজনৈতিক সমাধানের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, সেনা অভিযান কখনো শান্তি আনতে পারে না, সমস্যা সমাধানের সঠিকপথ হলো সংলাপ ও আলোচনা।