
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামলা আরও জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার (১৩ মে) দিবাগত মধ্যরাত থেকে গাজার বিভিন্ন জায়গায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গত এপ্রিলের শুরুতে পদত্যাগ করা ইসরাইলের উগ্র ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ অধিকৃত পশ্চিম তীরে দাঁড়িয়ে সরাসরি বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ হবে তখনই, যখন ফিলিস্তিনিরা গাজা ছেড়ে চলে যাবে।’ ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করে গোটা ভূখণ্ড দখল করার এই জায়নবাদী চক্রান্ত শুরু হয়েছিল শত বছরের বেশি সময় আগে।
১৯০০ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপজুড়ে ইহুদি নিপীড়নের মুখে জন্ম নেয় জায়নবাদ। ১৮৯০ সালে অস্ট্রিয়ান লেখক নাথান বার্নবাউম ‘জায়নিজম’ শব্দটির প্রবর্তন করেন। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জায়নবাদী কংগ্রেস, যেখানে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়।
হিব্রু বাইবেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বর্তমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল অঞ্চল ছিল ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত পবিত্রভূমি’, যা তাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে—এই দাবির উপর দাঁড়িয়েই গড়ে ওঠে ইসরায়েল রাষ্ট্রের রূপরেখা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ‘বেলফোর ঘোষণা’র মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাস্তা সুগম হয়। ১৯২২ সালে লিগ অব নেশনস কর্তৃক ব্রিটেন ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট পেলে ইউরোপের ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে প্রবেশ শুরু করে, আর স্থানীয় আরবদের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র অসন্তোষ।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। এর ৫৫ শতাংশ ইহুদিদের, আর ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য মাত্র ৪৫ শতাংশ। এ পরিকল্পনা ইহুদিরা মেনে নিলেও প্রত্যাখ্যান করে আরবরা।
নিজ ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের জন্য ‘প্ল্যান-ডি’ নামে এক ছক কেটে জায়নবাদীরা। ইসরায়েলি সশস্ত্র সংগঠনগুলো শুরু করে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও নিপীড়ন। ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে অন্তত ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজভূমি থেকে বিতাড়িত হন। তারা আশেপাশের আরব দেশগুলোতে আশ্রয় নেন। কখনোই আর নিজ ভূখণ্ডে ফিরতে পারেননি। অন্যদিকে যারা ফিলিস্তিনে রয়ে গেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের ইসরায়েলি জুলুম, সন্ত্রাস আর হত্যাযজ্ঞের মধ্যে জীবন পার করতে হচ্ছে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ শাসন শেষ হতেই স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন বেনগুরিয়ন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন। আর ফিলিস্তিনিদের উপর নেমে আসে আল-নাকবা বা মহাবিপর্যয়।
১৯৪৮ থেকে ২০২৫, ৭৭ বছরে চারটি যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হলে নিজ ভূখন্ডে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন ফিলিস্তিনিরা। আর এভাবেই অমানবিকতাকে যেন স্বাভাবিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে ইসরায়েল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযান পরিণত হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস মানবিক বিপর্যয়ে। এখন পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত, ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা।
২০২৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেন, ফিলিস্তিনিদের অন্য কোথাও পাঠিয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। একই পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানিয়ে ইসরায়েল গাজাকে স্থায়ীভাবে দখলে নেওয়ার উদ্যোগ জোরদার করেছে।
৭৭ বছর ধরে চলা নিপীড়নে আজও নিজভূমিতেই পরবাসী ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘের বারবার হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি। বরং, যুগে যুগে রাষ্ট্রীয় সমর্থনে তাদের অধিকার হনন চলছে। আজও শেষ হয়নি আল-নাকবা, বরং তা প্রতিদিনই যেন নতুন রূপে ফিরে আসে।
সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=NduSOuZrB_o
রাকিব