ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়া বন্দিশালায় আটক, মুক্তিপণ দিতে না পারায় লিবিয়ায় নির্যাতনে হত্যা

নিজস্ব সংবাদদাতা, চুয়াডাঙ্গা

প্রকাশিত: ০১:৫৭, ১৫ মে ২০২৫; আপডেট: ০১:৫৯, ১৫ মে ২০২৫

ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়া বন্দিশালায় আটক, মুক্তিপণ দিতে না পারায় লিবিয়ায় নির্যাতনে হত্যা

ছবি: সংগৃহীত

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের তরুণ জুনায়েদ হাসান প্লাবন (১৯) ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালাল ধরেন। এর আগে কথা হয় পাশের গ্রাম বেলগাছির যুবক লিবিয়া প্রবাসী সাগরের সঙ্গে। তার সঙ্গে চুক্তি ছিলো যেভাবেই হোক বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে পৌঁছে দেবেন। শেষ পর্যন্ত প্লাবনকে ইতালিতে না পাঠিয়ে লিবিয়ায় আটকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবারের সদস্যরা।

নিহত জুনায়েদ হাসান প্লাবন আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের দমসের আলীর ছেলে। বুধবার (১৪ মে) প্লাবনের মৃত্যুর বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত করেছেন। তবে মরদেহের কোনো সন্ধান জানতে পারেননি তারা।

স্বজন ও এলাকাবাসী সূত্র জানায়, দিনমজুর বাবার স্বপ্ন পূরণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গত ৮ মাস আগে স্থানীয় দালাল ও লিবিয়া প্রবাসী সাগরের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশ ছাড়েন প্লাবন। তাকে ঢাকা থেকে সরাসরি দুবাই নেওয়া হয়। দুবাই শহরে কয়েক দিন রাখার পর তাকে নেয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পরেই সেখানে মাফিয়ারা (দালাল চক্র) তাকে জিম্মি করে একটি বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায়।

চুক্তির ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করলেও পরবর্তীতে আরও ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। পরে প্লাবনের বাবা নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে মুক্তিপণ পরিশোধ করেন। এরপর গত ১ মাস থেকে আবারও প্লাবনের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন করে দালালেরা। তারা দাবি করে, আরও ১৬ লাখ টাকা দিলে প্লাবনকে ইতালিতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্লাবনের বাবা দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন সইতে না পেরে মঙ্গলবার (১৩ মে) লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় মারা যান প্লাবন।

বুধবার সকাল ৯টার দিকে ফোনে প্লাবনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তার পরিবার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অন্য অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের মাধ্যমে ১৩ মে রাতে প্লাবনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানানো হয়।

প্লাবনের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য উপজেলার বেলগাছি ইউনিয়নের মালিতাপাড়ার জান্টু মেম্বারের ছেলে লিবিয়া প্রবাসী সাগর। বাংলাদেশ থেকে তরুণদের লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে মুক্তিপণের অর্থ আদায় করেন তিনি। পরে মাফিয়াদের নির্যাতনে মৃত্যু হলে ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে লাশ লুকিয়ে ফেলতে বিভিন্ন পাঁয়তারা করেন।

প্লাবনের বাবা দমসের আলী বলেন, “দালাল সাগরের মাধ্যমে ছেলেকে ইতালিতে পাঠাইতে চাইছিলাম। ধরা খাওয়ার পরে লিবিয়ার দালাল আমার ছেলেকে বন্দি করে রাখে। এরপর নির্যাতন করে ধাপে ধাপে ২৫ লাখ টাকা নেয়। প্লাবনকে তিনবেলা ঠিকমতো খাইতেও দিত না। আমার পোলাডা অনেক কষ্ট করছে। তবুও ওর স্বপ্ন ছিল ইতালি যাবে। তাই দালালের কথামতো ভিটেমাটি যা ছিল, সব বেচে দিয়ে ছেলেকে ইতালি নিতে দালালের সঙ্গে ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ করি। কিন্তু দালাল আমাগো ভুল বুঝাইছে। আমার ছেলেকে হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার চাই।”

প্লাবনের বড় বোন স্বপ্না খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুঠোফোনে জানান, মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে, চড়া সুদে টাকা এনে তার ভাইয়ের পরিবার দালালের হাতে তুলে দিয়েছেন। কয়েক দফায় এই টাকা আদম দালাল সাগর তার চাচাতো ভাই জিম, তার বাবা ঠান্ডু ও মা বেদেনা খাতুনের মাধ্যমে বুঝে নেন। ছেলেকে ইতালিতে পাঠানোর স্বপ্নে এখন পুরো পরিবার নিঃস্ব। এ ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মাসুদুর রহমানের জানান, লিবিয়ায় তরুণ হত্যার ব্যাপারে তিনি অবগত নন। তবে ইতোপূর্বে মানবপাচার আইনে অভিযুক্ত সাগরের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা চলমান রয়েছে।

রাজীব হাসান কচি/রাকিব

আরো পড়ুন  

×