
ছবিঃ আল জাজিরা
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, দেশটির প্রেসিডেন্সি থেকে আগের একটি ইসরায়েলি হামলাকে “বিপজ্জনক উত্তেজনা” হিসেবে উল্লেখ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল সিরিয়ায় নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে।
শুক্রবার গভীর রাতে দামাস্কাস ও তার আশেপাশে, পাশাপাশি রাজধানী থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) উত্তর-পূর্বে হামা প্রদেশের গ্রামীণ এলাকাসহ সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে একাধিক ইসরায়েলি সামরিক হামলার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজের অনুমোদনে সেনাবাহিনী এসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা সিরিয়ায় একটি সামরিক স্থাপনা, সেই সঙ্গে “আকাশ প্রতিরক্ষা বন্দুক এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অবকাঠামোতে” হামলা চালিয়েছে।
দামাস্কাস থেকে আল জাজিরার ইমরান খান জানান, যেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে, সেগুলো সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল-আসাদের সরকারের সামরিক স্থাপনা। খান বলেন, “ইসরায়েল তার সীমান্তে একটি অস্ত্রসজ্জিত সিরিয়া চায় না, তাই তারা এর আগেও বহুবার এমন হামলা করেছে।”
উত্তেজনা ও প্রতিক্রিয়া
এই সপ্তাহে ইসরায়েল সরকার সিরিয়ার ড্রুজ সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগ তোলার পর থেকেই দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
শুক্রবার সকালে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের কাছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যে হামলা চালায়, তা ছিল একটি “স্পষ্ট বার্তা” সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে, যেটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাআ।
নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “আমরা দামাস্কাসের দক্ষিণে সিরিয়ার বাহিনীর অবস্থান কিংবা ড্রুজ সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো হুমকি মেনে নেব না।”
পরবর্তীতে, প্রেসিডেন্ট শারাআর দপ্তর হামলাটিকে “ঘৃণ্য হামলা, যা দেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস এবং নিরাপত্তা সংকট আরও গভীর করতে চায়” বলে অভিহিত করে।
তারা আরও জানায়, “সিরিয়া তার সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আপস করবে না এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় সকল সম্ভাব্য উপায়ে প্রতিরক্ষা অব্যাহত রাখবে।” সেইসঙ্গে আরব রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তাও চাওয়া হয়।
এটি ছিল চলতি সপ্তাহে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের কাছে দ্বিতীয় ইসরায়েলি হামলা।
ড্রোন, হামলা ও বেসামরিক হতাহত
আল জাজিরা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে দামাস্কাস ও তার গ্রামীণ এলাকায় কম উচ্চতায় নজরদারি ড্রোন টহল দিচ্ছে। সিরিয়ান সরকার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, এই ড্রোনগুলো ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর।
শুক্রবার, সুয়াইদার এক খামারে একটি অজ্ঞাত ড্রোন হামলায় চারজন নিহত হয়েছে বলে সিরিয়ার চিকিৎসা সূত্রের বরাতে জানিয়েছে আল জাজিরা আরবি।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিম সুয়াইদার কানাকের গ্রামে ইসরায়েলি আগ্রাসনে চারজন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন।
তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও জানায়, সাম্প্রতিক ঘণ্টাগুলোতে তারা সিরিয়ায় কোনো হামলা চালায়নি।
সাম্প্রতিক সংঘাত ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই সপ্তাহে সিরিয়ায় সরকারপন্থী বাহিনী ও ড্রুজ যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।
ড্রুজদের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ হিকমত আল-হিজরি এই সহিংসতাকে “গণহত্যামূলক অভিযান” বলে অভিহিত করে শান্তি রক্ষার লক্ষ্যে “আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের” দাবি জানান।
বৃহস্পতিবার, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেওন সা’র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা সিরিয়ার সংখ্যালঘু বিশেষ করে ড্রুজদের “সরকার ও সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের” হাত থেকে রক্ষা করে।
ইসরায়েল আগেই সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে “ইদলিব থেকে আসা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যারা দামাস্কাস দখল করেছে” বলে উল্লেখ করেছে।
আল জাজিরার খান আরও বলেন, প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের হামলাকে ইসরায়েল সরকার “সতর্কবার্তা” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে, যার মাধ্যমে তারা ড্রুজদের নিরাপত্তা রক্ষায় সিরিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়।
“তবে এই বক্তব্য ড্রুজ নেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। তাদের মতে, তারা ইসরায়েলের সহায়তা ছাড়াই নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম,” বলেন খান।
তিনি যোগ করেন, সিরিয়ার ড্রুজ সম্প্রদায় ও সরকারের মধ্যে “গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার” ফলে উত্তেজনা কিছুটা কমেছে।
এদিকে কাতার শুক্রবার ইসরায়েলি বিমান হামলাকে “একটি সরাসরি আগ্রাসন” এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানিয়েছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে দিয়েছে, ইসরায়েলের “পুনঃপুন আক্রমণ” সিরিয়া ও লেবাননে, এবং গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ, অঞ্চলজুড়ে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
সম্প্রদায়িক সহিংসতা
ড্রুজ সম্প্রদায় ১০ম শতাব্দীতে গঠিত একটি শিয়া ইসলামীয় শাখার অংশ এবং তারা প্রধানত সিরিয়া, লেবানন ও ইসরায়েলে বসবাস করে। অনেক ড্রুজ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতেও কাজ করেন।
সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসআদ আল-শাইবানী বৃহস্পতিবার বলেন, “জাতীয় ঐক্যই স্থিতিশীলতা বা পুনর্জাগরণের মূল ভিত্তি।”
তিনি এক্সে লেখেন, “যে কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপের ডাক, যেকোনো অজুহাতে বা স্লোগানে, পরিস্থিতিকে আরও অবনতি এবং বিভাজনের দিকে নিয়ে যায়।”
ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিদ্রোহী জোটের নেতৃত্ব নেওয়া প্রেসিডেন্ট আল-শারাআর সরকারের জন্য সম্প্রদায়িক সহিংসতা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিরিয়ায় সম্প্রতি মার্চ মাসে নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের মিত্রদের হাতে আলাওয়াইট সম্প্রদায়ের ১,৭০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হন বলে জানায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস।
এই আলাওয়াইট সম্প্রদায়ই পশ্চিম সিরিয়ার উপকূলীয় এলাকায় বাস করে এবং তারা ক্ষমতাচ্যুত আসাদ পরিবারেরই অংশ।
সূত্র: আল জাজিরা
মুমু