ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কোনো খবর রাখেনা দূতাবাস 

যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর ফাইল তলব

যুক্তরাষ্ট্র সংবাদদাতা  

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর ফাইল তলব

 রাশেদ চৌধুরী

জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দিতে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে নৈশভোজে যোগদানসহ একাধিক হাইলেভেল মিটিংয়ে জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। এর কোনো এক সময় আবারো বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরৎ পাঠানোর আনুষ্ঠানিক চিঠি তুলে দেবেন মার্কিন রাস্ট্রপতির হাতে।  

মামলাটি পুনরায় সচল হওয়ার পর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটা হবে আমেরিকার ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এই খুনীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা সহজ হবে। তার ভাগ্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের হাতে। 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনী ও  ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি মেজর (বরখাস্ত) রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরৎ পাঠানোর প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দু’বছর আগে। তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন পূনর্বিবেচনার জন্য তলব করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল। দু’বছর আগে এ প্রক্রিয়া শুরু হলেও কোনো খবর রাখে না ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।   

রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করার ১৪ বছর পর কারো নথি তলব করার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বিরল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের অধিবেসনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরৎ দেবার অনুরোধ জানান এবং এ সংক্রান্ত একটি ফাইল তার হাতে তুলে দেন। এর দুই মাস পর ৫ নবেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়ের কপিসহ এই বিচারে রাশেদ চৌধুীর ব্যাপারে যাবতীয় কাগজপত্র চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার কিছুদিনের মধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সব কাগজপত্র পাঠায় বাংলাদেশ।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ২৩ জুলাই অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের পুরো নথি তলব করা হয়। পরদিন ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘পলিটিকো’ তাদের অনলাইনে ‘হি থট হি হ্যাড এ্যাসাইলাম, নাও হি কুড ফেইস এ ডেথ সেন্টেন্স’ শিরোনামে সর্বপ্রথম এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর টনক নড়ে বাংলাদেশ দূতাবাস ওপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।

রাশেদ চৌধুরীর আইনজীবী আ্যাটর্নি মার্ক ভ্যান ডার হোট আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অনেক বছর আগে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়া একটি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনকে পুনরায় সামনে আনার কারণে অন্যান্য আবেদনকারীদের মধ্যেও আতংক কাজ করতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের আবেদনের কারণেই ট্রাম্প প্রশাসন রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় (পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম) বাতিল করে তাকে দেশে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে সেসময় জানিয়েছিলেন তার আইনজীবী।  

মামলাটি পুনরায় সচল হওয়ার পর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটা হবে আমেরিকার ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। 

বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এই খুনীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা সহজ হবে। তার ভাগ্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের হাতে। 

জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দিতে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে নৈশভোজে যোগদানসহ একাধিক হাইলেভেল মিটিংয়ে জো বাইডেনের সঙ্গে দেখা হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। এর কোনো এক সময় আবারো বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরৎ পাঠানোর আনুষ্ঠানিক চিঠি তুলে দেবেন মার্কিন রাষ্ট্রপতির হাতে। 

এর আগে সেনাসমর্থিত অন্তর্র্বতী সরকারের সময় ২০০৭ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদকে (বরখাস্তকৃত) বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। পরে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আরেক খুনী বরখাস্তকৃত রিসালদার মোসলেহউদ্দীনের এ্যাসাইলাম আবেদন নাকোচ করে তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। 
২০২১ সালে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মার্চ মাসে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পান মেরিক ব্রায়ান গারল্যান্ড। এরপর থেকে রাশেদ চৌধুরীর দৌড়ঝাপ বেড়ে যায়। নামি আইনজীবি নিয়োগ দিয়ে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের নথি তলবের বিষয়টি চাপা দিতে জোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। চলতে থাকে বিশেষ লবিং। কিন্তু সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রচেষ্টাই নেই এমনকি কোনো খোঁজ কবরই রাখে না ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস। অ্যাটর্নি জেনারেলের নথি তলবের বিষয়টি সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কেও জানে না দূতাবাস বা মন্ত্রণালয়ের কেউ। নেই কোনো মনিটরিং।

পলিটিকো পত্রিকাটি তাদের অনলাইন সংষ্করণে নিউজটি প্রকাশ করার পর রাশেদ চৌধুরীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে অনেকেই অনেক মন্তব্য করেন। কিন্তু তার বিপক্ষে মন্তব্য লেখার মতো বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, খুনী রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারলে সেটা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক বিজয়। 

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সেক্রামেন্টো থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরের শহর কনকর্ড সিটির হাকেলবেরি ড্রাইভ এলাকায় স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করছেন। এখানে তার একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। 

বারবার স্থান বদল করে ২০১৫ সালে বিলাশবহুল বাড়ি কিনে কনকর্ডে বসবাস শুরু করেন। এখানে তার ছেলে রূপম চৌধুরীরও মিলিয়ন ডলার মূল্যের বাড়ি আছে। এর আগে ক্যালিফোর্নিয়ার সেক্রামেন্টো, কলোরাডো, ইলিনয় এবং মিসৌরিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বসবাস করেছেন নৃশংস এই খুনী।  

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার পর ১৯৭৬ সালে কালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মেজর রাশেদ চৌধুরীকে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে তিনি কেনিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসেও কাজ করেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর এ খুনিকে চাকরি থেকে অব্যহতি দিয়ে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দেশে না ফিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো চলে যান। পরে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। ১০ বছর পর ২০০৬ সালে তার আবেদন গ্রহন করেন আদালত।

২০০৮ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে এমনটিই মনে করছেন আইনবীদরা।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশীরা জাতির পিতার খুনীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাসুদুল হাসান দৈনিক জনকন্ঠকে জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরৎ দেয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। এর আগেও বঙ্গবন্ধুর দুই খুনীকে ফেরৎ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এজন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ধন্যবাদ জানান।

এমএস

×