ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

অন্ধ মানুষ কি স্বপ্ন দেখে? 

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ১৮ জুন ২০২৫

অন্ধ মানুষ কি স্বপ্ন দেখে? 

স্বপ্ন এক গভীর মানসিক অভিজ্ঞতা, যেখানে আমরা দেখতে পাই দৃশ্য, শুনতে পাই শব্দ, অনুভব করি স্পর্শ কিংবা কখনও গন্ধও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—অন্ধ মানুষ কি স্বপ্ন দেখে? উত্তরটি হলো, হ্যাঁ। তবে তারা যেভাবে স্বপ্ন দেখে, সেটি ভিন্নরকম এবং তা নির্ভর করে তারা কখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে তার ওপর।

যারা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে অন্ধ হন, তারা এখনও স্বপ্নে ছবি বা রঙ দেখতে পান। কারণ, তাদের মস্তিষ্কে সেই চিত্রগুলি সংরক্ষিত থাকে। অন্যদিকে, যারা জন্ম থেকেই দৃষ্টিশক্তিহীন, তারা স্বপ্নে দেখতে পান না চিত্র বা রঙ। বরং তাদের স্বপ্নের অভিজ্ঞতা গড়ে ওঠে শব্দ, ছোঁয়া, গন্ধ কিংবা স্বাদ থেকে। গবেষণা বলছে, দৃষ্টিহীনরা তুলনামূলকভাবে স্বপ্নে দুঃস্বপ্ন বা আতঙ্কজনক দৃশ্যের মুখোমুখি হন বেশি।

স্বপ্ন ও ঘুমের স্তর: REM এর ভূমিকা

মানুষ যখন ঘুমের ‘র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট’ বা REM পর্যায়ে থাকে, তখনই মূলত স্বপ্ন দেখা হয়। এ পর্যায়ে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ে, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয় এবং চোখ দ্রুত নড়াচড়া করে। সাধারণত প্রতিরাতে এই REM ধাপে মানুষ দুই ঘণ্টা পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে, যদিও এটি বিভিন্ন ঘুমের স্তরের মাঝে বিভক্ত থাকে।

অনেক গবেষক মনে করেন, স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক বিগত দিনের স্মৃতি ও অনুভূতি সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। এই প্রক্রিয়ায় চাক্ষুষ স্মৃতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, শব্দ বা স্পর্শের মতো অন্যান্য অনুভূতিও এখানে জড়িত।

অন্ধদের স্বপ্ন ঠিক কেমন হয়?

আমরা যখন স্বপ্নের কথা বলি, তখন প্রথমেই চোখে ভাসে রঙিন দৃশ্যপট—একটি চলমান ছবির মতো। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের স্বপ্নে গন্ধ, স্বাদ কিংবা স্পর্শের উপস্থিতি থাকে মাত্র ১ শতাংশেরও কম। কিন্তু যারা অন্ধ, তাদের স্বপ্নে এই অনুভূতিগুলোর প্রাধান্য অনেক বেশি। কারণ, তারা দৈনন্দিন জীবনে যেমন অন্য ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করেন, স্বপ্নেও সেই ইন্দ্রিয়গুলোই মূল ভূমিকা পালন করে।

কেউ কেউ স্বপ্নে "দেখতেও" পান

সব অন্ধ ব্যক্তি কিন্তু পুরোপুরি ‘চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা’-বঞ্চিত নন। বিশেষ করে যাদের দৃষ্টিশক্তি সাত বছর বয়সের পর হারিয়েছে, তারা অনেকটাই সাধারণ মানুষের মতোই স্বপ্নে দৃশ্য দেখতে পান। কারণ, ওই বয়সের আগ পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্কে চিত্র, রঙ এবং পরিবেশের ধারণা তৈরি হয়ে যায়।

তবে সময়ের সাথে সাথে, যারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, তাদের স্বপ্নে সেই চিত্রপট ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে পারে। কেউ কেউ বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাঝেমধ্যে মাত্র দৃষ্টিগ্রাহ্য স্বপ্নের অভিজ্ঞতা পান।

অন্যদিকে, যারা জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন, তারা স্বপ্নে চিত্র নয়, বরং স্থান, দিকনির্দেশ, চলাচল এবং ব্যক্তিদের অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হন। স্বপ্নে তারা একধরনের মানসিক মানচিত্র বা spatial awareness গড়ে তোলেন, যার মাধ্যমে বুঝতে পারেন কোথায় কে বা কী আছে।

আবেগ ও দুঃস্বপ্ন: দৃষ্টিহীনদের ক্ষেত্রে ভিন্নমাত্রা

স্বপ্নের বিষয়বস্তু হয়তো দৃষ্টিসম্পন্ন ও অন্ধদের জন্য প্রায় এক হলেও, স্বপ্নের আবেগগত তীব্রতায় পার্থক্য দেখা যায়। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মগতভাবে অন্ধ ব্যক্তিদের স্বপ্নে হিংসাত্মক দৃশ্য এবং দুঃস্বপ্নের উপস্থিতি অনেক বেশি।

এর কারণ হতে পারে, তাদের মনে তৈরি হওয়া স্মৃতি ও অনুভূতির সংগঠন অপেক্ষাকৃত কম সুসংগঠিত হওয়ায় স্বপ্নের অভিজ্ঞতা বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। spatial ধারণার অভাবে তাদের স্বপ্ন অনেক সময় স্থান-কাল-পাত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আরেকটি তত্ত্ব বলছে, জন্মগতভাবে দৃষ্টিহীন বা শ্রবণহীন ব্যক্তিরা বাস্তব জীবনে বেশি হুমকিসংকুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। এর প্রতিফলনও স্বপ্নে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, বধির ব্যক্তিদের মধ্যেও দুঃস্বপ্নের হার অনেক বেশি।

স্বপ্নের বাস্তবতা অস্বীকার করার কিছু নেই

অন্ধ ব্যক্তিরা স্বপ্ন দেখেন ঠিক আমাদের মতোই হয়তো ভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, কিন্তু আবেগ, সম্পর্ক কিংবা অভিজ্ঞতার দিক থেকে তাদের স্বপ্নে কোনো ঘাটতি থাকে না। চোখের অনুপস্থিতি স্বপ্নকে ‘অবাস্তব’ করে তোলে না, বরং সেটিকে অন্যরকম এক বাস্তবতার রূপ দেয়, যা গভীরভাবে অনুভবযোগ্য।

 

 

সূত্র: Verywell Health

আফরোজা

×