ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বছরজুড়ে যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা ভুলে পর্যটকরা উপভোগ করছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য

ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে চাঙ্গা পর্যটন খাত

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ১১ জুন ২০২৫

ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে চাঙ্গা পর্যটন খাত

বান্দরবান সদরের ‘নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে’ পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়

এমনিতে ঈদের  সাধারণ ছুটিতেই জমজমাট থাকে দেশের পর্যটন খাত। তার ওপর এবারই প্রথম দশ দিনের দীর্ঘ ছুটিতে ছিল ঈদ। সঙ্গত কারণেই পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে  ভিড় ছিল নজিরবিহীন। বিশেষ করে কক্সবাজারে এখন পর্যটকদের মহাজমায়েত ঘটে গেছে। দীর্ঘ ছুটিতে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের পদচারণায় মুখর কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। চট্টগ্রাম, সিলেট,  রাজশাহী, বরিশাল, কুয়াকাটা যশোর, বগুড়া ও কুমিল্লা ঐতিহাসিক স্থান ও ট্যুরিস্ট হোটেল মোটেলে ভ্রমণপিপাসুদের বিচরণ চোখে পড়ার মতো। এমনকি রাজধানীর আশপাশের সাভার আশুলিয়া, পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও অন্যান্য দর্শনীয় স্পটগুলোতে মানুষের হুমড়ি খাওয়া ভিড়। 
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দশ দিনের ছুটিতে মানুষ আগে থেকেই বেড়ানোর পরিকল্পনা করে। সে কারণেই পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে নেমেছে পর্যটকের ঢল। এখন সায়মন, সুগন্ধা, কলাতলী, লাবণী, ইনানীসহ সব পয়েন্টেই মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। বছরজুড়ে যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা ভুলে পর্যটকরা উপভোগ করছেন সাগরের আবাহন। সেই সঙ্গে ভিড় রয়েছে হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেকসহ আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোতেও। পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে এসব স্থানে জড়ো হয়েছে অনেকেই। ফলে এই ঈদের ছুটিতে অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে দেশের পর্যটন খাত।

কক্সবাজারের সিগাল হোটেলের ৯০ শতাংশের বেশি রুম ৮ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত বুকিং হয়ে গেছে। সিগালের ফ্রন্ট ডেস্ক ব্যবস্থাপক  মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা বলা যায়, এবারের ঈদে কক্সবাজারে ব্যাপক পর্যটক আসছে। একইভাবে কক্সবাজারের মারমেইড বিচ রিসোর্ট ছুটির দশ দিনের মধ্যে ছয়দিন পুরোপুরি বুকিং আছে। 
এ ছাড়া নিকটবর্তী পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাঙ্গামাটিতেও ঢল নেমেছে পাহাড়প্রেমীদের। হ্রদ, লেক ও পাহাড়বেষ্টিত রাঙ্গামাটি ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় এখন মুখরিত। সবার আকর্ষণ ঝুলন্ত সেতু, সুখী নীলগঞ্জ, পলওয়েল পার্ক, রাজবন বিহার, কাপ্তাই লেক এবং শুভলং ঝর্ণা এবং সাজেক ভ্যালির প্রতি। যদিও প্রায় ২ বছর পর বান্দরবানের রুমার বগালেক এবং থানচিতে তুমাতুঙ্গি পর্যন্ত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আংশিক তুলে নেওয়ায়, সেখানেও রয়েছে পাহাড়প্রেমীদের ভিড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাগড়াছড়ির আলুটিলা, রিছাং ঝর্ণা, জেলা পরিষদ পার্কসহ অন্যান্য স্পটে বাড়তে শুরু করে পর্যটকদের ঢল। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে পাহাড়ি জেলাগুলোর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছেন তারা।
জানা গেছে, কক্সবাজার ও পাবর্ত চট্টগ্রামের পর বেশি ভ্রমণপিপাসুর আনাগোনা দেখা যায় সিলেটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট রয়েছে পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে। দীর্ঘ ছুটিতে সিলেটে পর্যটকের ভিড় আশানুরূপ হওয়ার প্রত্যাশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। করোনার পর থেকে পর্যটন শিল্প কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লেও এবারের ঈদের লম্বা ছুটিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভ্রমণের পরিকল্পনা অনেকেরই রয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের পরিচিত পর্যটন এলাকাগুলোতে এবার অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদের ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকের ভিড় সিলেটের পর্যটন খাত চাঙ্গা হয়েছে। এবার এ পর্যটন খাত থেকে শতকোটি টাকার বেশি ব্যবসা করার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটন স্পটগুলোতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে আগেভাগেই।
সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে এবার আগত পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটাই বাড়বে এমনটি আগে আঁচ করা গেছে। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.) মাজার, চা-বাগান, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর, উৎমা ছড়া, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, লালাখালসহ অন্যান্য জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলোতে ঈদের ছুটির দিনগুলোতে ভিড় জমছে ব্যাপক। কেননা পাহাড়, টিলা আর দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান যেন সিলেটকে ঢেকে রেখেছে সবুজ চাদরে। হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণসহ (র.) ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট নগর এবং পার্শ্ববর্তী বিমানবন্দর সড়কের দু’পাশে রয়েছে সিলেটের প্রথম চা-বাগান মালনীছড়া।

এ ছাড়া দৃষ্টিনন্দন লাক্কাতুরা চা-বাগান, কালাগুল, গুরজান, বাইশটিলা, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদের বারবার টানে। পাশের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে সাদাপাথর ও উৎমা ছড়ার মতো মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পট। জৈন্তপুুর উপজেলায় রয়েছে লালাখাল, ডিবির হাওর। গোয়াইনঘাটে রয়েছে জাফলং, রাতারগুল, পান্তুমাই ও বিছনাকান্দি। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ বিছনাকান্দি। এবারের ঈদে পর্যটন খাতে চাপ বেড়ে যাবেÑ এমনটা বিবেচনায় রেখে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিয়েছেন। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন, ট্রাভেল এজেন্সিগুলো তাদের সেবার মান বাড়াতে প্রস্তুত রয়েছে। সিলেটের হোটেলগুলো বুকিং আগেই শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, ঈদের ছুটির সময় পর্যটকদের উপস্থিতি ব্যবসার জন্য অনেকটা লাভজনক হবে এবং তারা তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
সিলেটের জৈন্তা হিলস রিসোর্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তোফায়েল আহমদ গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন- এখানে ৩০টি রুম রয়েছে। তার মধ্যে কাপল ১৬টি ও ডাবল বা ফ্যামিলি রুম ১৪টি আছে। এরই মধ্যে ১৭টি বুকিং হয়েছে, যা গত দুই ঈদের তুলনায় বেশি। এবার পরিবার-পরিজন নিয়ে ভ্রমণের সংখ্যাটা বেশি। তাই ছাড়ও দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সুন্দরবনের রিসোর্টগুলো, এমনকি ঢাকার বাইরেও বুকিং বেড়েছে। সরকারি ছুটিকে অনুসরণ করে ব্যাংক, এনজিওসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বাড়তি ছুটি ঘোষণা করেছে। দেশের স্কুলগুলোও দশ দিনের বেশি সময় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দীর্ঘ ছুটি ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বছর মানুষ দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বেছে নিচ্ছেন।

ফলে ৫ থেকে ১৪ জুনের ছুটির শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বেশিরভাগ হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট বুকিং হয়ে আছে। তবে আবহাওয়ার কারণে অনেকের ভ্রমণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসতে পারে। আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলে বুকিং আরও বাডতে পারে। খুলনার সুন্দরী ইকো রিসোর্টের বিক্রয় সহকারী রেদোয়ান আহমেদ সিয়াম বলেনÑ এবারের দীর্ঘ ছুটিতে সব বুকিং হয়ে গেছে। সুন্দরী ইকো রিসোর্টের মাত্র দুটি রুম বুকিং বাকি আছে। বাকিগুলো আগেই বুকিং হয়ে গেছে। 
একই অবস্থা ময়মনসিংহেও। এখানকার মেঘমাটি ভিলেজ রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুুল্লাহ কাফি জানান, ৮ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত তাদের সব রুম রিজার্ভ করা হয়ে গেছে। গত ঈদুল আজহায় মাত্র তিন দিনের ছুটি থাকায় পরিস্থিতি এমন ছিল না। তবে এবার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ভাড়া বাড়ায় দেশের বাইরে যাওয়ার পরিমাণ কমেছে। এভাবে চললে দেশের পর্যটন আরও ভালো করবে।
একই কথা জানান গাজীপুরের নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্টের হিসাব ব্যবস্থাপক নিতাই চন্দ্র সূত্র। সাধারণত ছুটির দিনে বুকিং বাড়ে। অনেকেই খোঁজ নিচ্ছেন, সেই তুলনায় বুকিংয়ের পরিমাণ কম। তবে সাজেক ভ্যালির চিত্র ভিন্ন, যেখানে এবার প্রি-বুকিংয়ের চাহিদা তুলনামূলক কম। বিপরীতে বর্ষা মৌসুমে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় বেশি নজর কাড়ছে। ঈদের পরদিন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত প্রায় সব হাউজবোট আগে থেকেই বুকিং হয়ে আছে। এবার ঈদের লম্বা ছুটির কারণে পর্যটন ব্যবসা বেড়েছে। আগের বছরগুলোতে কম ছুটি থাকায় মানুষের ভ্রমণ পরিকল্পনা ছিল সীমিত। বেশিরভাগ পর্যটক দুই বা তিন দিনের পরিকল্পনা করতেন। তবে এ বছর ১০ দিনের ছুটি থাকায় মানুষ দীর্ঘ সময় ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে রিসোর্টের ব্যবসা ভালো হচ্ছে।

×