
শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানে সমবেত সংগীত পরিবেশনা
শিল্পিত পথরেখায় শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদিত হলো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি। গানের সুরে জানানো হলো ভালোবাসা। কবিতার শিল্পিত উচ্চারণে স্মরণ করা হলো বাঙালির সাংস্কৃতিক বোধকে উদ্দীপ্ত করে যাওয়া মনীষীদের। বিশিষ্টজনদের আলোচনায় জানানো হলো বিন¤্র শ্রদ্ধা। এভাবেই নানা আয়োজনে বুধবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সরব হয়েছে রাজধানীর সংস্কৃতি ভুবন।
কথনের সঙ্গে গান ও কবিতায় সজ্জিত সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। শহীদদের স্মৃতিতে নিবেদিত স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে স্মৃতিচারণের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
হেমন্তের সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত আঙিনার নন্দন মঞ্চ থেকে নিবেদিত হয় শিল্পাশ্রিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। অনুষ্ঠানের শুরুতে একাডেমি কর্তৃক সারা দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে অনুষ্ঠিত গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটারের পোস্টার পরিদর্শন করেন অতিথিরা। এরপর জাতীয় সংগীতকে সঙ্গী করে মঞ্চে আসেন ঢাকা সাংস্কৃতিক দলের শিল্পীবৃন্দ। স্মরণের এ আয়োজনে স্বরচিত কবিতাপাঠ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মিনার মনসুর ও রুবি রহমান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন লায়লা আফরোজ।
আলোচনাসভায় প্রধান আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সাংস্কৃতিক সচিব মো. আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদের সন্তানের স্মৃতিচারণ ॥ শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আমাদের শৈশব-কৈশোর আনন্দের ছিল না।
একটা প্রতিকূল সময়ের ভেতর দিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা যেত না। পাঠ্যপুস্তকে বিকৃতভাবে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা হতো। সেখান থেকে আমরা এখন কিছুটা আলোর পথ দেখতে পাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানে এভাবেই অনুভূতি প্রকাশ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রিয় সাধন সরকারের ছেলে তাপস সরকার।
তাপস সরকার বলেন, বাবা যখন শহীদ হলেন আমার তখন দুই বছর বয়স। আমার বোন ছিল দুই-তিন মাসের শিশু। স্বভাবতই বাবার কোনো স্মৃতি আমাদের মনে নেই। বাবার কথা শুনেছি তাঁর ছাত্র, বন্ধু ও অন্যদের কাছে। তবে আমি দেখেছি মায়ের সংগ্রাম। মা যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এসেছেন। বাবা যখন শহীদ হলেন মায়ের বয়স ছিল মাত্র বাইশ বছর।
স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে শহীদ পিতাকে নিয়ে কথা বলেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার স্বাধীনতা সংগ্রামী শহীদ কাজী শামসুল হকের সন্তান কাজী সাইফুদ্দীন আব্বাস।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের গ্রন্থনা ও শিল্পী বুলবুল ইসলামের নির্দেশনায় পরিবেশিত হয় গীতিআলেখ্য। ‘মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে’ শীর্ষক বিশেষ পরিবেশনাটি উপস্থাপন করে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে সরকারি সংগীত কলেজ।
বাংলা একাডেমির আলোচনাসভা ॥ দিবসটি উপলক্ষে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এতে জাতিসত্তার বিনাশ ও বুদ্ধিজীবী উৎসাদন শীর্ষক বক্তৃতা করেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার ছেলে প্রকৌশলী রবিউল আফতাব। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সূচনা বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান।
মফিদুল হক বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনকালে আমরা বড় পরিসরে দেখতে চাইব বুদ্ধিজীবী উৎসাদনের ঘটনাধারা। এর থেকে আমাদেরকে নিতে হবে ইতিহাসের শিক্ষা। দীর্ঘ বিলম্বে হলেও বুদ্ধিজীবী নিধনের কতক ঘটনার বিচার আমরা সম্পন্ন করতে পেরেছি। এতে কেবল ঘাতকদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়নি, বরং ইতিহাসের রায়ও আমরা অর্জন করেছি। তিনি আরও বলেন, বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনাকে আমাদের দেখতে হবে বড় পটভূমিকায়। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী সামরিক অভিযান কেবল সূচনা করেনি, বাঙালি জাতিসত্তা ধ্বংস করতেই পরিচালিত হয়েছিল এই অভিযান।
রবিউল আফতাব বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যার দৃশ্য যারা দেখেনি তাদের পক্ষে ধারণা বা কল্পনা করাও সম্ভব নয় যে, কত ভয়াবহ ছিল সেই দিনের নৃশংসতা। এত মৃত্যু, এত রক্ত, এত নির্মমতা পৃথিবীর ইতিহাসে আর চোখে পড়ে না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকে আমরা যে বাংলাদেশ পেয়েছি সেখানে যদি আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারি, যদি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে গণতান্ত্রিকভাবে বেঁচে থাকতে পারি তাহলেই কেবল তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে।
উদীচীর আয়োজন ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে গান, আবৃত্তি, নাচের মাধ্যমে বিন¤্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। এদিন বিকেলে তোপখানার উদীচী চত্বরে এই স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনির তন্ময়, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি নিবাস দে, হাবিবুল আলম, প্রবীর সরদার ও জামসেদ আনোয়ার তপন। সাংস্কৃতিক পর্বে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সংগঠনের ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা।
একক সংগীত পরিবেশন করেন মায়েশা সুলতানা উর্বী, অনিমা সায়মা, সোনিয়া আক্তার ও আনিকা মাহমুদ রীমা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শিখা সেন গুপ্তা ও শিল্পী মরিয় বেগম তৃষা। দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।
শেষ হলো সমতলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ন্যাশনাল কনভেনশন ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা ঠাকুরগাঁও থেকে জানান, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দুদিনের সাংস্কৃতিক উৎসবে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ভালো লাগার স্বাদ পেয়ে আদিবাসী সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে নেচে গেয়ে আনন্দ উপভোগ করেছেন। এমনই দৃশ্য দেখা গেছে ঠাকুরগাঁওয়ে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সমতলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং সমাজের মূল স্রোতধারায় আনার লক্ষ্যে ন্যাশনাল কনভেনশন ও সাংস্কৃতিক উৎসবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছিল এর সমাপনী অনুষ্ঠান। এতে ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম।