ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আগ্রহ বাড়ছে কর্মমুখী শিক্ষায়

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ১৯:১৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১৯:৩৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

আগ্রহ বাড়ছে কর্মমুখী শিক্ষায়

তেজগাও কলেজে কিচেন রুমে শিক্ষার্থীরা।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পড়াশোনা শেষে চাকরির বাজারে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে কর্মের প্রেক্ষাপটের ভিন্নতায় হিমশিম খেতে হয় এসব শিক্ষার্থীদের। 

দেশে একদিকে যেমন শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে বাড়ছে যোগ্য কর্মীর সংকট। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু কর্মমুখী শিক্ষা। হাতেকলমে এ শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশুনো শেষ করার আগেই কর্মে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। যে কারণে শুধুমাত্র ক্লাসরুমের শিক্ষা নয়, কর্মমুখী শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের।

মারুফা নদী। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল তাকে ডাক্তারী পড়ানো। কিন্তু সরকারি মেডিকেলে সুযোগ না হওয়ায় পরে ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট। 

২য় বর্ষের এই শিক্ষার্থী জনকণ্ঠকে বলেন, ডাক্তারীতে বাবা মায়ের ইচ্ছা থাকলেও আমার আগ্রহ ছিল এয়ার হোস্টেজ বা ক্যাবিন ক্রু বা এয়ারপোর্টের কোন পেশায় যুক্ত হওয়া। আমার স্বপ্ন পূরণে এখানে আমি ভর্তি হয়েছি। সত্যি কথা বলতে এখানে এসেই আমি নিজেকে আবিস্কারের সুযোগ পেয়েছি। পড়াশুনার সঙ্গেই আামাকে অনেক তারকা হোলেটে ভিজিট করতে হয়। এয়ারপোর্টেও কর্মব্যস্ততার কিভাবে পরিচালনা করা হয় তা দেখারও সুযোগ হয়েছে। ৭ম সেমিস্টারে আমার ইন্টার্নশিপ শুরু হবে আমাদের। ভাল করলে সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগও আছে। এই পড়াশুনোয় আমি যেমন আনন্দ খুজে পাচ্ছি তেমনি আমার স্বপ্নের পথের হেটে চলেছি।

সরেজমিন ফার্মগেটের তেজগাও কলেজে গিয়ে দেখা যায় হোটেল রুমের আদলে একটি কক্ষ। সেখানে শিক্ষার্থীদের রুম সার্ভিসিং শেখাচ্ছেন শিক্ষকরা। অন্য একটি ঘরে আন্তর্জাতিক মানের কিচেন রুম। সেই কক্ষে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত রান্না-বান্নায়। একটি ঘর এমন ভাবে সাজানো যেন মনে হবে আপনি হোটেলের রুমে মাত্র চেক ইন করবেন। সেখানে অতিথিদেরকে অভ্যর্থনা অফিসিয়াল কাজ শেখানো হচ্ছে।

একই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তানজীর ইসলাম। সে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু এখন সে হোটেল ম্যানেজমেন্টেই ক্যারিয়ার গড়তে চায়। তার ইচ্ছা ৫ তারকা হোটেলে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করা। এছাড়াও সুযোগ পেলে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যটন কর্পোরেশনেও চেষ্টা করবেন। 

এই শিক্ষার্থী জানান, এখানে পড়াশুনো করে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজের সুযোগ রয়েছে। চাইলে দেশের বাইরেও যাওয়া যায়। তবে আমি দেশের ৫ তারকা হোটেলে নিজের ক্যরিয়ার তৈরি করতে চাই।

দেশে ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্তত ১০টি কলেজে এ বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া চলছে। দিনে দিনে আগ্রহ বাড়ায় আগামী বছর থেকে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। মূলত পড়া শেষে দেশি বিদেশি তারকা হোটেল, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, এয়ারলাইন্স, ক্রুজ লাইন, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনের সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ রয়েছে।

কলেজটির ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আজিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজটিকে বলা হচ্ছে পথপ্রদর্শক। এ কলেজটিতে এ বিষয়ের ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা এ বিভাগের ৩৫ জন শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করে বেরিয়েছে। সেই ৩৫ জনের প্রত্যেকেই চাকরির বাজারে প্রবেশ করেছে। এদের কেউ আছেন এয়ার লাইন্সে, কেই আছেন ৫ তারকা হোটেলে কেউবা নিজেই উদ্যোগী হয়ে রেস্টুরেন্ট খুলেছেন। 

কলেজটির শিক্ষকরা জানান, এ বিষয়ে ফ্রেঞ্চ ভাষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসে শিক্ষার্থীদের পড়ান। ৫ তারকা হোটেল ল্যা মেরিডিয়ানের হাউজ কিপিং ম্যানেজার শিক্ষার্থীদের হাউজ কিপিং এর প্যাকটিকাল ক্লাস নেন। কিন্তু ৫ তারকা হোটেলে শেফের একাডেমিক যোগ্যতা কম থাকায় ক্লাস কার্যক্রমে সমস্যা চলছে। অনেকে আছেন যারা দীর্ঘদিন দেশি বিদেশি হোটেলে প্রধান শেফের কাজ করছেন কিন্তু তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। যেকারণে এসব বিষয়ে হাতে কলমে পাঠদান দিতে সমস্যা হচ্ছে।

নীতিমালা আছে বিকাশ নেই 

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ১৭টি ৫ তারকা মানের হোটেল আছে। কিন্তু এসব তারকা মানের হোটেলে মধ্যম সারিতে যারা কাজ করে বাঙ্গালীরা। স্টেক হোল্ডার পর্যায়ে সবই ভারতীয় ও শ্রীলংকান। ফলে বিপুল পরিমান অর্থ বৈদেশিক কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছে। ২০০৫ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়তে টুরিজম বিষয়ে স্নাতক চালু হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও এ বিষয়ে স্নাতক রয়েছে। কিন্তু এ সংশ্লিষ্ট সরকারি নিয়োগে শিক্ষার্থীরা বিশেষ সুবিধা পায় না। সরকারি নিয়োগে বিষয়টি উল্লেখ করা থাকে না। 

ফলে সব বিষয়ের স্নাতকরা আবেদন করেন। এ বিষয়ের স্নাতক শেষ করা প্রার্থীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে অগ্রাধিকার চান। 

এছাড়াও তারকা হোটেলগুলোতে বেতন কাঠামো নেই। ৫ তারকা হোটেলে কতজন পার্মানেন্ট জনবল থাকবে তার কোন নীতিমালা নেই। শিল্প করা হলেও শিল্পের বিকাশের নীতিমালা করার উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। করোনার পর পার্মানেন্ট কর্মী বাদ দিয়ে অন কল কাজ করানোর অভিযোগও রয়েছে।

দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। সেখানে বিদেশি শ্রমিক কাজ করেন প্রায় পাঁচ লাখ। যারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স বাবদ নিয়ে যাচ্ছেন। 

এসব কর্মী ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করেন। কারণ  বাংলাদেশে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাব রয়েছে। সরকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে। কারিগরি বা কর্মমুখী শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদন দেয়া হয়েছে। 

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ বিষয় বিভাগ চালু করা হয়েছে। এগুলো বন্ধ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকনিক্যাল বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া জরুরি।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন, জাপানে উচ্চতর বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নথিভুক্ত ছাত্র প্রায় ২০ শতাংশ আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় বৃত্তিমূলক বা প্রশিক্ষণ খাত এমনভাবে বিকশিত যেখানে টারশিয়ারি শিক্ষার ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী জুনিয়র বা পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি হন। চীনে বিশ্বের বৃহত্তম বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা রয়েছে। যেখানে প্রায় ১১ হাজার ৩০০টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। 

প্রতিবছর সেখানে মোট ৩০.৮৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী ভর্তি হন এবং ১০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। চীনের উন্নয়নের পেছনে তাদের এই নীতি অনেক বেশি কার্যকর মনে হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে এই হার অনেক কম। 

শিক্ষিত বেকারকে কারিগরি বা প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ বা দক্ষ করে তুলতে পারলে মেগাপ্রকল্পে বিদেশি শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর প্রয়োজন হতো না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে এবং কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি আকর্ষণীয় করতে হবে। এর মাধ্যমে শুধু শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমানো হবে তা নয়। বরং কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ শ্রমিক বা শিক্ষার্থীকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বলছে, শিল্প ও পড়াশুনাকে সমন্বয় করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিল্প ও একাডেমিক যোগসূত্র। 

দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পে গবেষণা প্রয়োজন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দেবে গবেষণার কাজটি সম্পন্নের। এজন্য তারা অর্থ দেবে। প্রয়োজনে কোন শিক্ষার্থীকে ওই গার্মেন্টেসে কাজের সুযোগ দেবে। অথবা শিল্প মালিকরা উপস্থিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করবে।

 

সম্পর্কিত বিষয়:

×