মানহীন খাবার ভোগান্তিতে শিক্ষার্থী
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির মস্তিষ্ক। যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখি, সে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মেধার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সে তরুণদের গড়ে ওঠা কি ঠিকমতো হচ্ছে? শুধু র্যাগিং নয় মাদক, অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর হল, বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট, মানহীন খাবার, কোর্স শিক্ষকদের দায়িত্বহীন আচরণ এবং নানা ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার হতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। ফলে এক রাশ হতাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মানহীন খাবার পরিবেশন এখন অনেকটা নিত্য ঘটনা। দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় একই অবস্থা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এ রকম পচা-বাসি এবং মানহীন খাবার পরিবেশন এখন খবরের শিরোনামে।
বাসি-পচা খাবার পরিবেশনের অভিযোগে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হল ক্যান্টিনে তালা লাগিয়েছে শিক্ষার্থীরা। জুমার নামাজের পর দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী খাবার খেতে গিয়ে ভাতের মধ্যে পোকা দেখতে পান। তৎক্ষণাত উপস্থিত শিক্ষার্থীরা রান্নাঘর তল্লাশি করে দুই বস্তা নি¤œমানের কমদামের চাল, দীর্ঘদিন আগে মাখানো শেওলা ধরা আটা, পচা পেঁয়াজ ও সবজি উদ্ধার করে।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা জানান যে, দীর্ঘদিন যাবত হলের ক্যান্টিন মালিক মোবারক হোসেন তাদের মানহীন ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করে আসছে। বারবার বলার পরেও তিনি খাবারের মান উন্নত করেননি বরং খাবারের দাম বাড়িয়েছেন।
সরেজমিন ক্যান্টিনের গুদামঘর ও রান্নাঘর পরিদর্শন করে দেখা যায় রান্নার চুলোর পাশেই বাসন-কোসন ধোয়ার জায়গা। অস্বাস্থ্যকর উপায়ে খাবার রান্না করা হচ্ছে। ভাতের মধ্যে পোকা বা মাংসের মধ্যে পালক সেখানে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার নিয়ে চরম অসন্তোষ দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দাম অনেক বেশি, কিন্তু মান খুবই খারাপ। নোংরা পরিবেশে করা হয় খাবার পরিবেশন। পচা-বাসি খাবারও মাঝে মধ্যে দেয়া হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের ক্যান্টিনের ভেতর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে খাবার। টেবিলের নিচে ফ্লোরে ঢাকনা ছাড়া রয়েছে রান্না করা তরকারি। এর ওপর ভনভন করছে মাছি। সেখানে রাখা কাঁচা সবজিও অনেক আগের। এছাড়া ভাতের ঝুড়ির পাশেই ধোয়া হচ্ছে ময়লা থালা। এ সময় থালা ধোয়ার ময়লা পানি ছিটকে ভাতের ঝুড়িতে পড়তে দেখা যায়।
এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে হল ক্যান্টিনে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘হলে মাছের তরকারি খেলে মনে হয় শুঁটকি মাছ। কারণ দুর্গন্ধ বের হয়। এই খাবার কোন স্বাদের না। মুরগি খেলে মনে হয় যেন বাসি মুরগি। মিনিকেট চাল বলা হলেও ভাত অনেক মোটা। এটা মিনিকেট চাল হয় কিভাবে। অথচ এই খাবার খেতেই প্রতি মাসে আমাদের বিল আসে ৪ থেকে থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। হল ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। অভিযোগ করলেও কোন সমাধান মিলে না বলেন শিক্ষার্থীরা।’
এর আগে এক শিরোনামে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর। এখানে আবাসিক হলের সংখ্যা ১৪। প্রতিটি হলেই খাবারের জন্য ডাইনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ডাইনিংয়ের খাবারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু হলের ডাইনিংগুলোতে খাবারের মান ভাল নয়। যারা ডাইনিংয়ের খাবার প্রস্তুত করেন, খাবারের গুণগতমান, স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। খাবার তৈরি করা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলাস্থ (নির্দিষ্ট খাবারের স্থান) খাবারের দোকানগুলোতে প্রশাসন কর্তৃক একের পর এক নির্দেশনা দেয়ার পরেও থামছে না মানহীন খাবার পরিবেশনের প্রবণতা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব দোকানে নির্দিষ্ট করে দেয়া মূল্য তালিকারও তোয়াক্কা করছেন না দোকানদাররা। এমনকি একাধিক দোকানদারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত দাম আদায়ের অভিযোগও করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির হাজারও শিক্ষার্থী।
তাদের দাবি খাবারের দাম নিয়ে রীতিমতো ডাকাতি চলছে এখানে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হলগুলোর ডাইনিং এবং ক্যান্টিনের খাবারের মান অনেক নি¤œ মানের হওয়ায় শিক্ষার্থীদের একমাত্র খাবারের জায়গা বটতলাস্থ খাবারের দোকানগুলো। পুরো বটতলাজুড়ে প্রায় ৬০টি খাবারের দোকান রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন খাবার খায়। শিক্ষার্থীদের আর্থিক দিক বিবেচনা করে ইতোমধ্যে প্রশাসন থেকে কয়েকবার বটতলাস্থ খাবারের দোকানগুলোর মূল্য তালিকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু দোকান-মালিকরা প্রথম দিকে খাবারের মূল্যতালিকা মেনে দাম রাখলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই প্রশাসনের টানানো মূল্যতালিকা সরিয়ে ফেলে দ্রব্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত তুলে মানহীন খাবার পরিবেশন করে অতিরিক্ত দাম আদায় শুরু করেন। দোকান-মালিকদের এমন কর্মকাণ্ডে রীতিমতো অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে হলগুলোর ডাইনিং ও কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়াটিতে খাবার নিয়ে শিক্ষার্থীরা সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন। নিরাপদ ও পর্যাপ্ত খাবার থেকে শুরু করে মানসম্মত ও ন্যায্যমূল্যের খাবারের সঙ্কটে ভুগছেন তারা। এ ছাড়া রয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব। এসব দুর্ভোগ সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারির অভাবকেই দুষছেন শিক্ষার্থীরা।
দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে এবং হলে অবস্থান করে। কিন্তু দুঃখজনক হল, দেশের কোন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং হলের পরিবেশ মানসম্মত নয়। ডাইনিংয়ের খাবারের মানও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মানহীন খাবার খাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। সেখানে প্রতিদিন খাওয়ানো হচ্ছে প্রায় একই রকম সবজি। ফলে কোন কোন শিক্ষার্থীর নানা ধরনের অপুষ্টিজনিত রোগ দেখা দিচ্ছে।